জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সহযোগীদের নানা প্রতারণার ঘটনা প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে নারী উন্নয়নের নামে আছিয়া নীলা ও নিশার মতো অসংখ্য ভণ্ড ও প্রতারকদের জাতি ইতোমধ্যে দেখেছে। আজ আমরা জান্নাতুস সাফা শাহীনুর নামের আরেক প্রতারক ও ভণ্ডামির নানা কাহিনী তুলে ধরব।

নারী অধিকার ও উন্নয়নের নামে প্রতারণার শুরু সাধারণত কোনো নারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। জান্নাতুস সাফাও সেই একই পথে এগিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দিনাজপুর উইমেন চেম্বার অফ কমার্স। তবে দিনাজপুর উইমেন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে রেজিস্ট্রেশনের সময় বয়সজনিত সমস্যায় পড়েন। নিজের বয়স কম দেখিয়ে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে তিনি এই জটিলতা কাটিয়ে ওঠেন। এরপর একের পর এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিনাজপুরের স্থায়ী বাসিন্দা এবং ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র আমাদের হাতে এসেছে, যেখানে জান্নাতুল সাফা শাহীনুর তার বোন, মা, এবং ভাইয়ের স্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করেন, যাদের কেউই দিনাজপুরের স্থায়ী বাসিন্দা নন। এর আগে তিনি ভুয়া এনআইডি ব্যবহার করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৩ বছরের মেয়াদী “প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির” একটি প্রকল্পের জন্য ৬ কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বরাদ্দ নেন।

এছাড়া তিনি নিজেও একাধিক প্রতিষ্ঠান, সমিতি, উন্নয়ন সংস্থা এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গঠন করেন। এসব প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, আইসিটি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) থেকে সরকারের বিভিন্ন ফান্ড সংগ্রহ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার নামে ও বেনামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আমাদের অনুসন্ধানে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে:

সভাপতি, কলোনীপাড়া মহিলা উন্নয়ন সমিতি (KMDS)
সভাপতি, কলোনীপাড়া যুব মহিলা উন্নয়ন সংস্থা ও পাঠাগার (KJMDSP)
সভাপতি, কলোনীপাড়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (KSUS)
সভাপতি, কলোনীপাড়া মহিলা উন্নয়ন সমিতি টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (KMDSTTI)
এছাড়া প্রতারণা অব্যাহত রাখতে তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদ পাওয়ার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। এভাবে তিনি মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী তথ্য-প্রযুক্তি লীগ; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গুলশান থানা মহিলা আওয়ামী লীগ; মহিলা বিষয়ক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী বাস্তুহারা লীগ; সভাপতি, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী বাস্তুহারা লীগ; এবং আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির মতো বিভিন্ন পদ দখল করেন।

আমাদের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জান্নাতুস সাফার প্রতারণা থেকে তার বাড়ির মালিকও রেহাই পাননি। তিনি প্রথমে ফ্যামিলি নিয়ে থাকার কথা বলে বাসা ভাড়া নেন। যেহেতু বাড়ির মালিক দিনাজপুরে থাকেন না, সেহেতু তিনি বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারেননি। পরে মালিককে না জানিয়ে সাফা বাসাটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। মালিক বাড়ি ছাড়ার আইনি নোটিশ দিলেও তিনি আপত্তি জানান এবং আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে বাড়ির মালিককে হুমকি দেন। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি বিএনপির আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তবে এখনও বাড়ি ছাড়তে চাইছেন না।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, এসব মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্তমান সরকারের ভূমিকা কী? সাধারণ মানুষের মুক্তি কবে মিলবে এই মাফিয়াদের হাত থেকে?