ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের স্বনামধন্য সূর্যমুখী কিন্ডার গার্টেন এন্ড গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম ও পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালের মার্চে জেলা প্রশাসক বরাবর সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জীবন ভট্টাচার্য এর সহযোগিতায় প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম এবং সভাপতি রফিকুল ইসলামের শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতি তদন্তের জন্য আবেদন করেন তৎকালীন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আ ফ ম কাউসার এমরান এবং সালাউদ্দিন আহমেদ। স্কুলের আয়ের টাকা প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে রেখে তা লোপাট করেছেন এই নিয়ে একাধিকবার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও তৎকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের আশ্রয় প্রশ্রয়ের কারনে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা বা তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অভিযোগে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম নিয়ম বহির্ভূতভাবে স্থানীয় জনতা ব্যাংকে নিজের নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফান্ডের টাকা সেখানে রাখেন। ওই প্রতিষ্ঠানের নামে দুটি বেসরকারি ব্যাংকে যৌথ অ্যাকাউন্ট থাকা সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষক তার নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন এবং খরচ করেন। এ বিষয়টি জায়েয করতে প্রতি অর্থবছরের শেষে প্রধান শিক্ষক তার পছন্দের লোক নিয়োগ করে দায়সারা অডিট করিয়ে নেন। তবে ২০২১-২০২২ এবং ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে অডিট রিপোর্ট সম্পন্ন করা হয়নি। এ নিয়ে আবেদনকারীরা বারবার কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
প্রতি বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের নিকট ভর্তির ফরম বিক্রির বিপুল পরিমান টাকা প্রধান শিক্ষক যৌথ ব্যাংক একাউন্টে জমা না রেখে নিজের নামের একাউন্টে নিজ ইচ্ছে মত খরচ করেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সদস্য প্রকৌশলী সালাউদ্দিন আহমেদ প্রশ্ন করলে প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন না করার অনুরোধ করেন। বলা হয়, এসব অনিয়মের সঙ্গে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলামের যোগসাজশ রয়েছে। প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম তার ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইয়ের শ্যালকের স্ত্রী, বান্ধবীর মেয়েসহ আত্মীয়-স্বজন ও নিজের পছন্দের লোক এবং সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলামের পুত্রবধূকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তাছাড়া বিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র ও বিধি অনুযায়ী, কোন শিক্ষক-কর্মচারীর বয়স ৬০ পূর্ণ হলে তার পদে থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু প্রধান শিক্ষক সালেমা বেগমের বয়স ৬৯ হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বপদে বহাল রয়েছেন। শিক্ষক ও স্টাফদের বয়স ৫৯ হলে তিনি পরিচালনা কমিটির নজরে আনেন এবং উক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর নিকট থেকে আবেদন নিয়ে এক বা দুই বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করেন। প্রধান শিক্ষক সালমা বেগমের বয়স গত বছরের ১৫ জানুয়ারি ৬৯ বছর পূর্ণ হয়। তার চাকুরির বয়স সীমা ৬০ বছর পার হলেও তিনি কয়েক দফা মেয়াদ বর্ধিত করেন।
লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিচালনা পর্ষদের সভায় তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত চাকুরির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ৪ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষক একটি সভা আহবান করে উমরাহ হজ্বে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে চাকুরির মেয়াদ ১৮ মার্চ পর্যন্ত আরেক দফা বর্ধিত করার আবেদন করেন। নিয়ম না থাকলেও প্রতিষ্ঠানের সভাপতি প্রধান শিক্ষকের ওই আবেদন অনুমোদন করেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক উক্ত তারিখে অবসরে না নিয়ে উল্টো কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সভাপতি রফিকুল ইসলামের সহযোগিতায়২০২৩ সালের ১৮ মার্চ ২৪ ঘন্টার নোটিশে কমিটির সভা ডেকে কার্যনির্বাহী পরিষদ ভেঙ্গে দেন। এরপর তার আজ্ঞাবহ সদস্য কামরুল ইসলামকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটিতে একজন সদস্যকে আহবায়ক, সহকারি প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানাকে সদস্য এবং তিনি নিজে সদস্য সচিব রয়ে যান।
জানা যায়, ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অত্যন্ত স্বনামধন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছেন। প্রতিটি শিক্ষার্থী মাসে ৮ শ টাকা বেতন দিয়ে থাকেন। স্কুলটিতে বর্তমানে ৫৪ জন শিক্ষক শিক্ষকতা করছেন। বিদ্যালয়টির হিসাবরক্ষক কার্তিক চন্দ্র সরকারের সহায়তায় প্রধান শিক্ষক আর্থিক অনিয়ম করে যাচ্ছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সালমা বেগম বলেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার সময়ে অনুমোদন পাওয়ার জন্য নিজের নামে ব্যাংকে একাউন্ট করতে হয়েছে। পরে আরো দুটি ব্যাংকে যৌথ একাউন্ট করা হয়েছে। টুকটাক খরচের টাকা তো আর আমার ব্যাগে রাখতে পারি না। তাই একাউন্টে রেখে খরচ চালাই।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেক শিক্ষককেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে। নিজের বয়সসীমা বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের তারা তো আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদ্য সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম অবশ্য প্রধান শিক্ষক সালমা বেগমের ব্যক্তিগত একাউন্ট থেকে টাকা খরচের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, অনেক সময় ছোট-খাট খরচ, যেমন- হঠাৎ করে বিজনেস বিল আসলো, কোন কিছু নষ্ট হয়ে গেল-তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাবে কোথায়। সেজন্য প্রধান শিক্ষকের ব্যক্তিগত একাউন্টে আলাদা রাখা হয়।
বার্তাবাজার/এস এইচ