আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনতে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে ৭১টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে মাত্র ২৭টি এমএলএআরের জবাব পেয়েছে সংস্থাটি। পাচারের অর্থ ফেরানোসহ দুর্নীতিবিষয়ক সমস্যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল গত ১ অক্টোবর দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার রেকর্ড আছে দুদকের। দুদকের পাশাপাশি এনবিআর, সিআইডি ও বিএফআইইউর জোরালো ভূমিকা জরুরি।-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
এর আগে একই বিষয়ে আলোচনার জন্য গত ২৬ সেপ্টেম্বর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। গত ১০ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এবং ৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সঙ্গে বৈঠক করে। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে দুদক। দুদক সংস্কারে গঠন করা হয়েছে কমিশন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। যাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে অর্থ পাচারের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। আর গত এক মাসের কম সময়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দুদক।
দুদকের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সহজ নয় বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার রেকর্ড আছে দুদকের। দুদকের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) জোরালো ভূমিকা জরুরি। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ৭১টি চিঠির মধ্যে জবাব এসেছে মাত্র ২৭টির। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে সহযোগিতা চেয়েছি।-দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।
অর্থপাচার রোধে দুদকের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে অর্থপাচারের বিষয়টি হলে তখন তা দুদকের এখতিয়ারে আসে। শুধু তখন এটা দেখতে পারে দুদক। তাদের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছে অর্থপাচার রোধ আইনের মাধ্যমে। দুদকের হাত থেকে সরিয়ে এই ক্ষমতা সিআইডিকে দেওয়া হয়েছে। এটা সিআইডির এজেন্ডা ছিল না। দুদকের পাশাপাশি এনবিআর, সিআইডি, বিএফআইইউ- এসব সংস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে দুদকের সাফল্য মাত্র একটি। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে ২১ কোটি ৫৫ হাজার টাকা ফেরত আনে দুদক। এর পর প্রায় এক যুগে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে দুদকের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচার করা এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে চায় বলে জানিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে তাদের অবহিত করছি। দুদকের পক্ষ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব সংস্থার পক্ষ থেকেও সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। আদালতের অনুমতি নিয়ে দুদক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমএলএআর পাঠায়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যোগাযোগ করা হয়। তবে অতীতে, এই তৎপরতাটুকুও দেখা যায়নি।-দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম ।আক্তার হোসেন বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ৭১টি চিঠির মধ্যে জবাব এসেছে মাত্র ২৭টির। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার বা ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং, হুন্ডি ও পণ্যের আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রভাবশালীরা অর্থপাচার রোধকারী সংস্থাগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে বিনা বাধায় এসব অর্থ পাচার করেছে। আবার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল।
এসব বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম বলেন, অর্থ ফেরত আনতে সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। আদালতের অনুমতি নিয়ে দুদক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমএলএআর পাঠায়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে যোগাযোগ করা হয়। তবে অতীতে এ তৎপরতাটুকুও দেখা যায়নি। টাকা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। সদিচ্ছার অভাবেই মূলত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে দুদকের সফলতা কম।
বার্তাবাজার/এস এইচ