টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার বনের ভিতরে লাইসেন্স ছাড়াই বন কর্মকর্তাদের অনুমতি বিহীন চলছে ১২১ করাতকল এবং বনের কোল ঘেষে এক থেকে দেড় কিঃ মিঃ মধ্যে গড়ে উঠেছে আরও ৬২ করাতকল ও পৌর এলাকায় লাইসেন্স নিয়ে চলছে আরও ২৪ করাতকল।

এইসব অবৈধ করাতকলে বৈধ গাছ ছাড়াও প্রতিনিধি বনের গাছ চিড়াই করে গোপনে কাঠ বাইরে পাচার করায় বনাঞ্চল ছাড়াও সংরক্ষিত বন দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। দায়িত্ব প্রাপ্তরা তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন না করায় একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে বন, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে তার রাজস্ব। সেই সাথে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার পরিবেশ। সর্বোপরি অতিরিক্ত বন নিধনে বিপর্যস্ত হচ্ছে গোটাজাতি।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার ধলাপাড়া রেঞ্জের আওতাধীন ৮৮.৪৫ বর্গ কিঃ মিঃ বনাঞ্চলের মধ্যে বটতলী, ঝড়কা, চৌড়াসা, দেওপাড়া, ধলাপাড়া ও সাগরদিঘী সহ ৬টি বিটের ৪৯টি মৌজায় বনভূমি ও সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ২৯১০৬.৭৬ একর। এই বিশাল বনভূমিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির আকাশমনি, মিনিজিয়াম, ইউকিলপটার সেগুন সহ গজারির শালবন। এই শালবনের ভিতরে বিদ্যুৎ ছাড়াই ডিজেল মেশিন দিয়ে চলছে ১২১ করাতকল। একমাত্র এসব অবৈধ করাত কলের সহযোগীয় প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকার বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তার পরেও এসব করাত কলের বিরুদ্ধে কার্যকরী অভিযান না থাকায় অনেক সংরক্ষিত বাগান বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

জানা যায়, বনবিভাগের বিধানে বনাঞ্চলের ১০ কি: মি: এলাকার মধ্যে করাতকল স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তার পরেও বনকর্মকর্তাদের এক কালিন মোটা অংকের টাকা সেলামী দিয়ে মিল মালিকরা এসব মিল স্থাপন করছে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেঞ্চ অফিস ও বিট অফিসের নাকের ডগায় মিল মালিকরা করাতকল স্থাপন করে দিন রাত চোরাই গাছ চিড়াই করছে। ২৮ জুন সাগরদিঘী বিটের আওতাধীন রফিকের করাত মিলে গজারী গাছ ছাড়াও রোটস্ এন্ড হাইওয়ে (সিএনবি) রাস্তার বিশাল আকারের আকাশমনি গাছ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে ওই মিল মালিক রফিক জানায়, (সিএনবি) রাস্তার গাছ আমার মিলে বেপারীরা এনেছে, আমার শুধু গজারী গাছ। পরে গাছের ছবি তুলতেই এলাকার চিহ্নিত বন ধ্বংসকারী পার্শ্ববর্তী অবৈধ করাত কলের মালিক ফজলুল হক সাংবাদিকের সাথে খারাপ আচরন করে কাজে বাধা দেয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বনের ভিতরে এইসব অবৈধ করাতকলের ৯০ ভাগ মালিক কাঠ ব্যবসায়ী। কাঠ চোরদের সাথে মিল মালিকদের রয়েছে দহরম সর্ম্পক। যারা সর্বদা বনের গাছ চুরি করে তাদের মধ্যেও অনেক সংঘবদ্ধ হয়ে করাতকল স্থাপন করে বনের গাছ নিধন করে যাচ্ছে। এসবের পরেও সংশ্লিষ্ট রেঞ্চকর্মকর্তা, বিটকর্মকর্তা ও ফরেষ্ট গার্ডদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় বছরের পর বছর জুড়ে এসব অবৈধ মিল চালু রয়েছে। বনের সার্বিক অবস্থা দৃষ্টে মনেই হয় না এসব করাতকলের নিয়ন্ত্রণে কার্যকারী ব্যবস্থা নিতে কোন কর্তৃপক্ষ নেই ঘাটাইল তথা টাঙ্গাইলে।

বনের ভিতরে এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাকড়াই, ধলাপাড়া, নলমা, দেওজানা, ছনখোলা, চাপড়ি বাজার, পেচারআটা, শালিয়বহ, গারোবাজার, লক্ষিন্দর সাগরদিঘী, জোড়দিঘী, দেওপাড়া, শিবেরপাড়াসহ আরও বিভিন্ন স্থানে বনের ভিতরে ডিজেল মেশিন দিয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ করাতকল। সেই সাথে বনের কোষে ঘেষে আমতলা, দেউলাবাড়ী, পাকুটিয়া, পোড়াবাড়ী, ঝড়কা, বানিয়াপাড়া, মাইধারচালা, দেলুটিয়া ও অন্যান্য স্থানে লাইসেন্স ছাড়া ঘুষ দিয়ে চলছে অবৈধ করাত কল। এভাবে যততত্র করাতকল স্থাপন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় বনাঞ্চল ছাড়ও সংরক্ষিত বন আজ হুমকির মুখে দাড়িয়েছে।

এসব করাত কলের বিষয়ে পৌর করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম জানান ঘাটাইল উপজেলায় মোট ২০৩টি করাত কল রয়েছে, তার মধ্যে পৌর এলাকার ২৪টি বাদে বাকী সবটিই অবৈধভাবে গড়ে উঠায় একদিকে ধ্বংস হচ্ছে বন, অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে তার রাজস্ব। তাই অবৈধ করাতকল উচ্ছেদের জন্য জোর দাবী করেন তিনি।

বনের ভিতরে অবৈধ করাতকল কিভাবে চলে জানতে চাইলে সাগরদিঘী বিটকর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, করাতকল বন্ধ করতে অভিযান অব্যাহত আছে। আমি টাঙ্গাইল মিটিংয়ে আছি এ বিষয়ে পরে কথা বলব।

উপজেলা বন ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম লেবু বলেন, আমি মাসিক আইন শৃংখলা মিটিং এ করাতকল উচ্ছেদের জন্য বার বার বলে আসছি। বলার পরে ২/১ টা করাত কল বন্ধ করে পরবর্তীতে তারা অন্যান্য করাতকল মালিকদের সাথে যোগাযোগ করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। তাই আমি বন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করব তারা যেন করাতকল বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনিয়া চৌধুরী জানান, বনের ভিতরে স্থাপিত অবৈধ করাতকল উচ্ছেদের প্রক্রিয়া সবসময় চলমান। অভিযোগ পেলে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

বনের ভিতরে স্থাপিত অবৈধ করাতকলের বিষয়ে টাঙ্গাইল বন বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, সামাজিক বনায়নে সাথী ফসল আমরা দিয়ে থাকি, তবে বনের সংরক্ষিত এলাকায় করাতকলের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে এবং আগামীতে আরও জোরদার করা হবে।

বার্তাবাজার/রাহা