প্রতিবছর ২৫ শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস উদযাপিত হয়।

ফার্মাসিস্টরা দেশে বিদেশে মানসম্মত ওষুধ তৈরির মাধ্যমে স্বাস্থসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ফার্মেসি পেশায় কর্মরতদের উৎসাহ প্রদান এবং এই পেশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ২০১০ সাল থেকে সারাবিশ্বে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর আগে বিশ্বব্যাপী ফার্মাসিস্টদের পালনের জন্য বিশেষায়িত কোনো দিবস ছিল না। বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস উপলক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও মতামত তুলে ধরেছেন মোঃ রাকিবুল ইসলাম।

ফার্মোসি বিষয় সম্পর্কে মানুষ যথাযথ জানে না-

ফার্মেসিকে জানা আর ফার্মাসিস্টদের জানা এক নয়। ফার্মেসি শিল্পে ফার্মাসিস্টদের সম্পর্কে মোটামুটি যে একটা ধারণা রাখা হয় তার অনেকটুকুই ধীরে ধীরে নিপতিত হয় ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ বা ‘রিটেইল ফার্মেসি’ এর ধারণায়। যেখানে একজন ফার্মাসিস্ট ডাক্তার কর্তৃক নির্ধারণকৃত ঔষধের মান যাচাই, সঠিক কার্যকারিতা, প্বার্শপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক বিবেচনা করেই রোগীকে সঠিক মাত্রার ঔষধ সম্পর্ক অবগত করে। শুধু তাই নয়, একজন ফার্মাসিস্ট তার রোগীর রোগ, বয়স, এবং ওজনের দিক বিবেচনায় রেখে প্রয়োজন অনুসারে ডোজ ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে মেডিসিন সরবরাহ করে থাকেন। কারণ একজন ফার্মাসিস্ট বায়োটেকনোলজি সম্পর্কে ও পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন। ফার্মাসিস্টরা নতুন ওষুধের গবেষণা ও পরীক্ষায়ও অবদান রাখে। তারা ফার্মেসি, মেডিকেল ক্লিনিক, গবেষণা খাতে, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ডাক্তার এর কাছ থেকে শারীরিক অসুস্থতা জানার পর কোন ঔষধ কতটুক পরিমাণ এ কীভাবে গ্রহণ করা যায় কিংবা অন্যান্য সাইড ইফেক্ট থাকলে কোন ধরনের ঔষধ কতটুক গ্রহণ করতে হবে এই বিষয়ে সুক্ষ্ম ধারণা পাওয়া যায় একজন ফার্মাসিস্টের থেকে। অন্যদিকে রিটেইল ফার্মেসির কাজ প্রেসক্রাইব বা নন প্রেসক্রাইব ইত্যাদি যা একজন হেলথ কেয়ার প্রফেশনাল ফার্মাসিস্টই করতে পারে। অথচ এগুলোকে অনেকেই শুধু হসপিটালের এ দরজা থেকে ও দরজা এবং ঔষধের দোকানে টহল দেয়াকেই বুঝে থাকে! তাই স্বাস্থ্যসেবার এই গুরুত্বপূর্ণ পেশাদারীদের পেশা সম্পর্কে সঠিক ধারণা আগে জানতে হবে।

আ.ম. খালেদ মোমেন ইফায
ফার্মেসি বিভাগ
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের অবহেলার সুযোগ নেই-

আনন্দবাজারের এক রিপোর্ট এ বলা হয়েছিল, ‘বিশ্বের অনুন্নত ৪৮ দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২৫৭ কোম্পানির ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ। বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। রফতানি বাড়ছে দ্রুত। আর এসব সফলতার মুখ দেখছে নিরলসভাবে ফার্মাসিস্টদের কর্ম স্পৃহার জন্য। ফার্মাসিস্টদের অদম্য মেধা এবং যোগ্যতার এক অনন্য উচ্চতার বহিঃপ্রকাশ- ওষুধ-সংক্রান্ত ‘গবেষণা’ খাত। করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে সবাই যখন লকডাউনে বন্দী, তখন ফার্মাসিস্ট, গবেষকেরা অচেনা যোদ্ধার ন্যায় নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে , টিকা আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ জন্য বলা হয়ে থাকে, ‘A doctor saves a patient, but a pharmacist saves the entire nation’। তাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের অবহেলার সুযোগ নেই।

শাহরিয়ার শুভ
ফার্মেসি বিভাগ
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

মেডিকেল টিমে ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার-

হসপিটাল ফার্মাসিস্ট সব মেডিকেলে থাকা অবশ্যক এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি, ঔষধের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। কিভাবে ওষুধ টি কাজ করবে, কিভাবে ব্যবহার করলে অপটিমাম ইফেক্ট পাওয়া যাবে, রোগীর কেমন ডোজ এবং ডোজেস ফর্ম এর ওষুধ প্রয়োজন, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, সম্ভাব্য ঔষধের মিথস্ক্রিয়া, পেশেন্ট কাউন্সিলিং ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখে একজন ফার্মাসিস্ট। যদিও ডাক্তাররা ডায়াগনোসিস থেকে শুরু করে ট্রিটমেন্টও দিচ্ছে কিন্তু ফার্মাসিস্ট ইফেক্টিভ মেডিকেশন নিশ্চিত করে থাকে। হসপিটালে যাতে রোগী সর্বোচ্চ সুবিধা পায় সেজন্য ফার্মাসিস্ট এর গুরুত্ব ভীষণ। যাতে ডোজ থেরাপি থেকে শুরু করে যাবতীয় সব ঠিকভাবে হয়। ডোজ বেছে নিতে চিকিৎসকদের তেমন নতুনত্ব দেখা যায় না। একটা রোগীর বয়স, ওজন, উচ্চতা, প্রিভিয়াস হেলথ হিস্টোরি ড্রাগ রেজিস্টেন্স রোগীর মানসিক ভাবমূর্তি পর্যালোচনা করে রোগীর জন্য স্বতন্ত্র ডোজ দিতে একজন ফার্মাসিস্ট দরকার। ওষুধ কার্যক্ষম তখনই হবে, যখন ডোজ রোগীর জন্য নিশ্চিত করা যাবে, শুধু ব্র্যান্ড প্রমোট করে ডোজ ডেলিভার করে দিলে রোগীদের খরচও বাড়ে। তাই ডক্টরদের পাশাপাশি অবশ্যই হসপিটালে একজন রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্টের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে উন্নত দেশের মতো প্রতি ১০০ টি বেড এর জন্য কমপক্ষে ১৫ জন ফার্মাসিস্ট থাকবে।

ইসরাত জাহান ইমু
ফার্মেসি বিভাগ
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

ফার্মাসিস্টরা যথাযথ মর্যাদার অধিকারী হোক-

ফার্মেসিতে পড়াশোনা শুরু করার আগে থেকেই শুনতাম পড়াশোনা শেষ করার আগেই চাকরি হাতের মুঠোয় থাকবে। কিন্তু যখন পড়াশোনা শুরু করলাম দেখলাম অধিকাংশেরই ধারণা মেডিসিনের দোকানদার হব। বিষয়টা ভালো, গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখনো অধিকাংশের চিন্তাভাবনায় অনেক গোড়ামি দেখেছি। ওষুধ নিয়ে জানাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ এটা এখনো মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়নি। এই যে প্রতি বছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বের হচ্ছে, দিন শেষে দেখা যাচ্ছে ফার্মাসিস্ট না হয়ে বাধ্য হয়ে অন্য সেক্টরে সুইচ করতে হচ্ছে। ফার্মেসি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চালু হলেও, এই বিষয় নিয়ে পড়ার যতটা ঝোঁক, সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে এই আগ্রহ ঠিক ততটাই কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ফার্মাসিস্টরা সমাদৃত হলেও আমাদের দেশে এখনো স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি সংযুক্ত নয়। তাই এ দিবসে একমাত্র প্রত্যাশা হলো উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও ফার্মাসিস্টরা যথাযথ মর্যাদার অধিকারী হোক।

ফারিয়া আক্তার
ফার্মেসি বিভাগ
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

ফার্মাসি শিক্ষার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-

দেশে বর্তমানে পাস করে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের প্রায় ৯০ শতাংশই কাজ করেন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ওষুধ তৈরিতে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট হিসেবে এবং ৩০ শতাংশ কাজ করবে হসপিটালে। এদিকে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেশে কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট ও হসপিটাল ফার্মাসিস্টের পদ সৃষ্টি বা নিয়োগ হচ্ছে না।ফলে পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর পাস করে বের হওয়া বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট কর্মসংস্থানে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ফার্মেসি পড়াশোনা এবং গবেষণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই পর্যাপ্ত গবেষণাগার এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। ওষুধ কোম্পানি, হাসপাতাল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নীতিগত সমঝোতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নীতিমালা প্রয়োগ করে উন্নত দেশের অনুরূপ কমিউনিটি ফার্মেসি, হসপিটাল ফার্মেসি এবং ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্র এবং দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান আরও বৃদ্ধি করতে হলে নতুন ওষুধ উদ্ভাবন, জৈব প্রযুক্তিগত ওষুধ তৈরি, ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বিভিন্ন রোগের কারণ জানার জন্য গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন অনেক প্রয়োজন।

বার্তাবাজার/এস এইচ