ব্যাংকের ভল্টের টাকায় অবৈধ বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। ঋণ দিতে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সিন্ডিকেট। আর্থিক সংকটে পড়া ব্যক্তিদের ভল্টের টাকায় অতিগোপনে অতি উচ্চ সুদে অবৈধভাবে ঋণ দেন তারা। তাদের কাছ থেকে এমন উচ্চ সুদে নিয়ে বেকায়দায় পড়েন উত্তরার এক ব্যবসায়ী। এরপর তাকে নানা রকম হয়রানি করা। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে এ সিন্ডিকেটের ভল্টের টাকায় অবৈধ ঋণ বাণিজ্যের বিষয়টি ফাঁস করেন তিনি। খবর যুগান্তরের।

সংবাদ মাধ্যামটির এক প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীর নাম সুজা উদ্দিন। তিনি রাজধানীর উত্তরার একজন তরুণ ব্যবসায়ী। হঠাৎ ব্যবসায় পুঁজির সংকটে পড়লে উপায় খুঁজতে গিয়ে এক আত্মীয়ের শরণাপন্ন হন। পরে এ থেকে উত্তরণের সমাধান মিলে যায়। সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হয়। ব্যাংকের সুরক্ষিত ভল্ট থেকে অতিগোপনে বেআইনিভাবে ৫৫ লাখ টাকা বের করে সুজার হাতে তুলে দেন ওই কর্মকর্তা।

ঋণ দেওয়ার সময় শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, এক মাস পর সুদ-আসল মিলিয়ে ৭০ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। তার শর্তে রাজি হয়ে অস্বাভাবিক চড়া সুদে এই টাকা নেন সুজা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে টাকা ফেরত দিতে না পারায় তাকে নানাভাবে হয়রানির কবলে পড়তে হয়। পরে বাধ্য হয়ে ফাঁস করে দেন সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখায় কর্মরত অসৎ কর্তাদের ভল্টের টাকায় অবৈধ বাণিজ্যের তথ্য।

শুধু সোনালী ব্যাংকের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখায় নয়, অসৎ কর্মকর্তাদের ভয়ংকর সিন্ডিকেট বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবে অবৈধ এ কারবার বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. সুজা উদ্দিন বলেন, ব্যবসায় মন্দার কারণে সময়মতো টাকা দিতে পারিনি। এখন প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ যোগ করা হচ্ছে। এ হারে সুদ দিয়ে টাকা পরিশোধে অপারগতা জানালে আমাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকার পতনের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দিয়ে আমার বাড়ি ও অফিস ঘেরাও করা হয়। দেওয়া হয় হুমকি-ধমকি। তখন আমি প্রাণভয়েও ছিলাম। আমি টাকা যেহেতু নিয়েছি, ফেরত দেব। এজন্য একটু সময় লাগবে। আর ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা যেন এ অবৈধ ব্যবসা করতে না পারে, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার ব্যবস্থাপক নাজমুল আজমের নেতৃত্বে পাঁচ কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট এ অনৈতিক বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের অপারেশন অফিসার, দুইজন অফিসার এবং একজন অফিস সহকারী। তাদের হাতে অর্ধশতাধিক গ্রাহক আছে। যাদের বেশির ভাগ সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী। তারা কাস্টমস থেকে মালামাল ছাড়াতে টাকার সংকটে পড়লে এ চক্রের সদস্যদের দ্বারস্থ হন। তিন থেকে পাঁচ দিনের চুক্তিতে দ্বিগুণ হারে সুদ দেওয়ার শর্তে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা বের করে দেন চক্রের সদস্যরা।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন (এসি) সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন উত্তরার একজন ব্যবসায়ী। তিনি দীর্ঘদিন এই চক্রের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনে জড়িত। সব মিলিয়ে তার লেনদেনের অঙ্ক ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই ঠিকাদারের মাধ্যমেই উত্তরার তরুণ ব্যবসায়ী সুজা উদ্দিন চক্রের জালে আটকা পড়েন। এক মাসের জন্য ২০ লাখ টাকা সুদ দেওয়ার শর্তে ৫৫ লাখ টাকা নেন তিনি। কিন্তু ব্যবসায় মার খাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে টাকা ফেরত দিতে না পারায় চক্রের সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহাঙ্গীর হোসেন তার অফিসে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেন। একই সঙ্গে তাকে সাফ জানিয়ে দেন টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত দিনে ৪০ হাজার টাকা সুদ যোগ হবে আসলের সঙ্গে। এ অবস্থায় উপায় না দেখে ব্যাংক কর্মকর্তাদের এ অনৈতিক বাণিজ্যের তথ্য ফাঁস করে দেন তিনি।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার ব্যবস্থাপক নাজমুল আজম বলেন, ভল্টের রক্ষিত টাকায় এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসার কোনো সুযোগ নেই। কোনো কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যবসা করে থাকলে তার সঙ্গে ব্যাংকের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কেউ যদি আমার সম্পর্কে এ ধরনের কোনো অভিযোগ করে থাকে, সেটি সত্য নয়।

একই শাখার অপারেশন অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন এ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, প্রতিদিন কর্মঘণ্টার মধ্যেই ভল্টের টাকা মিলিয়ে আমাদের ব্যাংক থেকে বের হতে হয়। এক টাকা গরমিল থাকলে আমরা হিসাব ক্লোজ করতে পারি না। ভল্টের টাকা বের করে কাউকে দেওয়ার সুযোগ নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ভল্টের টাকার গরমিল থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হয়। কিন্তু গত ১৬ বছর ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে যার ইচ্ছামতো চলেছে। নিয়মিত ব্যাংকের ভল্ট পরিদর্শনও করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন গভর্নরও লুটপাটে মত্ত ছিলেন। তাই কোনো কিছুই কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভল্টের টাকা কোনোভাবেই অন্য কাউকে দেওয়ার সুযোগ নেই। সেই সুরক্ষিত ভল্টের টাকা দিয়েই কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে অবৈধ ব্যবসা করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এমন অনেক ঘটনা ধরাও পড়েছে।

বার্তাবাজার/এমআই