মণিপুরে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিক্ষোভে উত্তাল এই রাজ্যের তিন জেলায় কারফিউ চলছে। এছাড়া ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ রাখা হয়েছে। গত কয়েকদিনে দফায় দফায় গুলি বিনিময়, বোমা বিস্ফোরণ, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, মণিপুর রাইফেলসের দুটি ব্যাটালিয়নের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রশস্ত্র লুটের চেষ্টাসহ একাধিক ঘটনায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবস্থা সামাল দিতে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও যৌথ বাহিনী।
সহিংসতা বাড়তে থাকায় ইম্ফল ইস্ট, ইম্ফল ওয়েস্ট এবং থাউবাল জেলায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। এর আগে এক নির্দেশনায় ইম্ফল ইস্ট এবং ইম্ফল ওয়েস্টের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোর ৫টা থেকে সকাল ১০ পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের ঘোষণা দেন। তবে সহিংসতা বাড়তে থাকায় মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে কারফিউ শিথিলের নির্দেশ বাতিল করে পুণরায় ওই দুই জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। তবে মিডিয়া, বিদ্যুৎ, আদালত এবং স্বাস্থ্যখাতের মতো জরুরি সেবা কারফিউয়ের আওতার মধ্যে পড়বে না বলেও জানানো হয়।
এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, আপনি যদি লক্ষ্য করে দেখেন যেভাবে ওই অঞ্চলে ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হয়েছে তা স্বাভাবিক নয়। সেনাবাহিনীর ৫৭ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশনের সদর দফতরের খুব কাছ থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে। যদিও ওই এলাকায় সরাসরি ২২ আসাম রাইফেলসের অধীনে। ড্রোন কোত্থেকে ওড়ানো হয়েছে সেই জায়গা নির্দিষ্টভাবে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। সেটা কেন গেল না এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে।
আবার সেখানে হোমমেড রকেট দিয়ে প্রায় কয়েক ঘণ্টা হামলা চালানো হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী কেন ধরতে পারল না কাউকে? এগুলো করা হলে তো মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নামতেন না। মানুষ তো মনে করছেন যে তারা একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় আছে। পুলিশ বলছে, বুধবার নতুন করে কোনো সহিংসতা না ঘটলেও মঙ্গলবার সারাদিন দফায় দফায় যে ছাত্র-আন্দোলনকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। রাত পর্যন্ত পরিস্থিতি অশান্ত ছিল।
এডিটর্স গিল্ড অব মনিপুরের মহাসচিব ও সিনিয়র সাংবাদিক ওয়াই রূপাচন্দ্র সিং জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাত পর্যন্তও গুলির শব্দ শোনা গেছে ইম্ফলে। বহু জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। একাধিক জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে। তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে অনেক ধরণের ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছে, ভুয়া খবরও ছড়াচ্ছে। এখানে নাকি স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ পথে নেমেছেন। মনিপুরে কোনো স্বাধীনতার দাবি ওঠেনি। বরং মেইতেই আর কুকি- দুই গোষ্ঠীই এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে যে কারা কত বেশি ভারতের জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারে।
মনিপুর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আইজি কে কবিব বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ইম্ফল উপত্যকায় বহু বিক্ষোভ হয়েছে। ইম্ফল পূর্ব, বিষ্ণুপুর, কাকচিঙ এবং ইম্ফল পশ্চিমে বিক্ষোভ মিছিলগুলো বেশ শান্তিপূর্ণই ছিল। তবে ইম্ফল পশ্চিমের কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। কাকোয়া বাজার এলাকার বিক্ষোভে বন্দুকসহ সহিংস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। উরিপক অঞ্চলের একটি বিক্ষোভে পেট্রল বোমাও ছোঁড়া হয়েছে। ওই ঘটনায় ১০ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেক ছাত্র ছিল। তবে যারা আহত হয়েছেন বা ধরা পড়েছেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উস্কানিদাতাও ছিল। এরা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দা নন।
মঙ্গলবার কারফিউ জারি হওয়ার পর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর যৌথ ফ্ল্যাগ মার্চ চলছে এবং রাজধানী ইম্ফলের রাস্তায় যানবাহন খুবই কম চলছে বলেও জানিয়েছেন আইজি কে কবিব। গত বছরের মে থেকে মেইতেই এবং কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা গত কয়েকমাস ধরে একরকম বন্ধই ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকে আবারও সহিংসতা শুরু হয়েছে। গত ১০ দিনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাও আছেন।
সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে গত মাসে দুই দফায় একটা অডিও টেপ ফাঁস হয়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের কথিতকথোপকথনের ফাঁস হয়ে যায় বলে দাবি করা হয়েছে। প্রথম দফায় কুকিদের একটি সংগঠন এবং তারপরে একটি জাতীয়-স্তরের ইংরেজি সংবাদ পোর্টাল ওই অডিওটি ফাঁস করে। ক্ষমতাসীন বিজেপির কয়েকজন কুকি জনগোষ্ঠীর বিধায়কসহ ওই জনজাতির বিভিন্ন সংগঠন ফাঁস হয়ে যাওয়া অডিও কথোপকথনের সূত্র ধরে অভিযোগ করে যে গত বছর থেকে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে, তা আসলে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়েরই মস্তিষ্ক-প্রসূত। তিনিই কুকিদের ওপরে হামলা চালিয়ে জাতিগত নিধন চালাতে শুরু করেন বলে ওই ফাঁস হওয়া অডিও টেপে শোনা গেছে। ওই অডিওতে মুখ্যমন্ত্রীর গলা শোনা গেছে বলে মনে করছে কুকিরা।
তবে রাজ্য সরকার লিক হয়ে যাওয়া ওই কথেপাকথনের বিষয়ে অত্যন্ত কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল। তারা বলেছিল ওই ‘জাল’ অডিও টেপের মাধ্যমে কোনো একটি অংশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। এই ‘ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে এবং এতে জড়িত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ওই কথোপকথনের পুরোটাই বিচারপতি লাম্বা তদন্ত কমিশনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে বলে কুকি সংগঠনগুলো জানিয়েছে। গত বছর মে মাস থেকে মনিপুরে সহিংসতার কারণ খুঁজে দেখছে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ওই তদন্ত কমিশন।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে যেসব সহিংসতা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ড্রোন থেকে বোমা হামলার ঘটনা। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি একধরনের মিসাইল বা রকেটও ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রূপাচন্দ্র সিং।তিনি বলেন, আমাদের এক সাংবাদিক ড্রোন ব্যবহার করে বোমা নিক্ষেপের সাক্ষী। প্রথমবার যখন ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হচ্ছিল সেখানে হাজির মানুষজনকে তিনি সাবধান করে দিয়ে দ্রুত সরে যেতে বলেন। কিন্তু পরের হামলায় তিনি নিজেই আহত হন। বোমা হামলার জন্য ড্রোনের ব্যবহার এই প্রথমবার দেখা গেল মনিপুরে।
নিরাপত্তা বাহিনীগুলোও বলছে যে, শুধু মনিপুরে নয় পুরো ভারতেই এই প্রথমবার ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হলো। যেসব কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মনিপুরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছে তাদের মধ্যে অন্যতম বিএসএফ। সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া বলেন, ভারতে আমরা এরকম হামলা আগে দেখিনি। তবে মনিপুর লাগোয়া মিয়ানমারে সেখানকার বিদ্রোহীরা ড্রোন থেকে নিয়মিতই বোমা হামলা চালিয়ে থাকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপরে হামলা চালাতে তারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। আর এটাও আমরা জানি যে কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর শিবির রয়েছে মিয়ানমারে। সেখান থেকে তারা নিয়মিতই সরঞ্জাম নিয়ে আসে।
মনিপুর আর মিয়ানমারের সীমান্তে অনেক ফাঁকফোকর আছে। আবার মিয়ানমারে চীনের তৈরি সস্তার ড্রোন সহজলভ্য। মনিপুরে যেসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ওই ধরণেরই ড্রোন। অতএব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কোথা থেকে এই প্রযুক্তি আনা হয়েছে। এতে আমরা মোটেই আশ্চর্য হচ্ছি না। ড্রোন থেকে বোমা হামলা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থানীয়ভাবে তৈরি একধরণের মিসাইল বা রকেট ব্যবহার করা হয়েছে সাম্প্রতিক সহিংসতায়। রূপাচন্দ্র সিং বলেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এসব মিসাইলকে এখানে বলা হয় পম্পি। সেটারও চলতি মাসের সহিংসতায় ব্যবহার করা হয়েছে।
পম্পি অবশ্য মূল শব্দ ‘বম্পি’র বিকৃত রূপ। বম্পির মধ্যে ‘বম’ অংশটি হলো বোমা আর পি অর্থ বড়, মানে বড় বোমা। কিন্তু এখন শব্দটা বদলে গিয়ে পম্পি হয়ে গেছে।এগুলো একেবারেই স্থানীয়ভাবে তৈরি মর্টার এবং রকেট গোত্রীয় বোমা। দেশীয় প্রযুক্তির এই অস্ত্রগুলো মণিপুরে খুবই সহজলভ্য। এর আগেও এর ব্যবহার দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুকি জনজাতিভুক্ত এক কলেজের অধ্যাপক বলেন, এসব ড্রোন থেকে বোমা হামলা বা দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র সাম্প্রতিক সহিংসতায় ব্যবহৃত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো যে কুকি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকেই ছোড়া হয়েছে তার তো কোনো তদন্ত এখনও হয়নি। এভাবে নিশ্চিত করে কী বলা যায় যে, এসব মারণাস্ত্র কুকিরাই ছুঁড়েছে?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপকের পাল্টা প্রশ্ন, সহিংসতা, বোমা হামলা ইত্যাদির কথা বলা হচ্ছে। কুকি অঞ্চল থেকে হামলা হচ্ছে, এটাও বলা হচ্ছে। কিন্তু তার ঠিক আগেই যে মুখ্যমন্ত্রীর একটা কথোপকথন ফাঁস হলো তা নিয়ে তো বিশেষ প্রচার দেখছি না জাতীয় সংবাদমাধ্যমে। যদিও ওই ফাঁস হয়ে যাওয়া কথোপকথনে গলাটা মুখ্যমন্ত্রীরই কি না, তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি কিন্তু ফাঁস হয়ে যাওয়া ওই কথোপকথন থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই নতুন করে এই সহিংসতা শুরু হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
নিরাপত্তাজনিত কারণে বর্তমানে মনিপুরের বাইরে অবস্থান করছেন এমন একজন মানবাধিকার কর্মী বলেন, ওই অডিও টেপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে নিশ্চিতভাবেই মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা বিব্রত হয়েছেন। তারপরেই দেখা গেল যে সহিংসতা শুরু হলো। ওই মানবাধিকার কর্মীও নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। তার কথায়, অডিও কথোপকথন ফাঁস হওয়া, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে মিছিল-বিক্ষোভ আর তারপরেই নতুন করে সহিংসতা এই সবই একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এটা বলা যাবে না যে কোনো একটা কারণে নতুন করে সহিংসতা ছড়ালো। এর সঙ্গে ভুয়া তথ্য, ভুয়া ভিডিও এবং ভুল খবর ছড়ানোর ব্যাপারগুলোতো আছেই। তবে সবই যে ভুয়া খবর বা ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে তাও নয়। সত্য ঘটনাও আছে। কোনো একটি বিষয়কে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। তবে এই সহিংসতা কবে থামবে তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না। রূপাচন্দ্র সিং বলছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী একটা সময়সীমা দিয়েছিলেন যে ছয় মাসের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তারপরেই তো নতুন সহিংসতা শুরু হলো। আবার কুকি জনজাতির ওই অধ্যাপকের কথায়, কবে যে এসব থামবে, তা বলা কঠিন।
অপরদিকে বিএসএফের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া মনে করেন, শুধু নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। মনিপুরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পর্যায়ে তার সমাধান খুঁজতে হবে।
বার্তাবাজার/এস এইচ