গত ১৫ বছরে পতিত স্বৈরশাসক নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠতে সংবিধানকে কাঁটাছেড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল যে, একজন নাগরিক চাইলেও সংবিধানটি সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলতে পারবেন না। তাই তিন পদ্ধতিতে সংবিধান পুণরায় প্রণয়ন করা যেতে পারে বলে মতামত ব্যাক্ত করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাব পেশ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সোসাইটি ফর ডেমক্রেটিক রাইটস (এসডিআর)। সংগঠনের সভাপতি ব্যারিস্টার ইকবাল হোসেনের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আলিমুল হক লিটনের উপস্থাপনায় এতে আরো বক্তৃতা করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার ইকবাল হোসেন, ইংল্যান্ড ভিত্তিক পেশাজীবী নেতা নসরুল্লাহ খান জুনায়েদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাইমুল আহসান খান ও সাংবাদিক ওয়ালি উল্লাহ নোমান প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা নেওয়াটা সংবিধানের কোন বিধান প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে না। তারাও দৃশ্যত: সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন বা মানতে পারছেন, আবার অন্য অংশ কিংবা বহু অংশ মানছেন না বা মানতে পারছেন না।
সংবিধান যে কি আজগুবি অবস্থায় আছে তা কয়েকটি উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। প্রথমত: ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করা যাবে। যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল ও নজীরবিহীন এবং এক সঙ্গে ৩০০+৩০০ মোট ৬০০ এমপি স্বল্পসময়ের জন্য হলেও নির্বাচিত থাকেন একসঙ্গে। এই বিধানের প্র্যাকটিস পতিত সরকার করেছেনও।
দ্বিতীয়ত: ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, রদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এমনভাবে লিখে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে, পতিত সরকার বা তাদের কোন দোসর যদি কোনভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে বর্তমান সরকারের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে।
তৃতীয়ত: ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু স্পিকার যদি অসমর্থ বা অনুপস্থিত হন তাহলে কে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, এই বিষয়টি সংবিধান অনুধাবন করেনি।
চতুর্থত: ৪৭ অনুচ্ছেদে অনেক বিধান আছে যা সরাসরি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের সরাসরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। পঞ্চমত: সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সিংহভাগ সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ অযোগ্য ঘোষনা করা হয়েছে।
তারা বলেন, দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে শতাব্দির সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ট গণ-অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া বর্তমান সরকারকে সংবিধান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। আশার কথা যে সরকার এ সম্পর্কে গতকাল ড. শাহদীন মালিককে চেয়ার করে একটি কমিশন গঠন করেছেন। আমরা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। সংবিধান নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে তিনটি অপশন খোলা।
প্রথম অপশন : গত ১৫ বছরে কাঁটাছেড়া করা সংবিধান ভেঙ্গে সম্পূর্ন নতুন একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ আসনে নির্বাচন করে সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করা। এটির একমাত্র ও কেবলমাত্র কাজ হবে সংবিধান রচনা ও গৃহিত করা। এর সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য এক সাথে গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে।
আমাদের সংবিধানের শুরু ও যাত্রা ছিল গলদপূর্ন। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে গ্ৰহন করার জন্য ১৯৭০ সালের পাকিস্তান আমলের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) এর অধীনে নির্বাচিত এমপি দ্বারা গঠন করা হয় সাংবিধানিক পরিষদ। এখন প্রশ্ন হলো – মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে খোদ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া দেশের সংবিধান রচনা ও অনুমোদন সেই পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে নির্বাচিত এমপিরা করেন কিভাবে? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক মেধাবী প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল ।
দ্বিতীয় অপশন: ৫০/৬০ জন বিশেষজ্ঞ (সংখ্যা কমবেশী হতে পারে) নিয়ে সংবিধান প্রনয়ন কমিটি বা কমিশন গঠন করা। যাদের একমাত্র দায়িত্ব হবে নতুন একটি সংবিধান ড্রাফট করা। এই নতুন সংবিধান সুষ্ট, অবাদ ও সত্যিকার অংশগ্রহনমূলক গণভোটের মাধ্যমে গৃহিত হবে। একই সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে, যেভাবে বৃটেনে একদিনে একাধিক নির্বাচন হয়।
তৃতীয় অপশন হলো- ১/১১ সরকারের মতো এই সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ ১/১১ সরকারের মতো যতদিন থাকবে, থেকে যাবার পর পরবর্তী সরকার এসে তাদের মেয়াদ, চলমান কার্যাবলী ও সংবিধান পরিবর্তনের বৈধতা দিবে।
তারা বলেন, প্রথম অপশন বা দ্বিতীয় অপশনে যাওয়া হবে উত্তম। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সফল গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে আসা জাতির জন্য এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতিকে নতুন একটি সংবিধান উপহার দেওয়া সময়ের দাবি। নতুন সংবিধান রচনা করা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক সরকার তাদের স্বার্থ ছাড়া সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে হাত দিবে না।
বার্তাবাজার/এসএম