হান্নান হোসাইন শিমুল। র্যাপ গায়ক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যখন উত্তাল দেশ তখন বারুদের মতো র্যা প গান ‘আওয়াজ উডা’ গেয়ে আলোচিত হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের এই তরুণ। গান গেয়ে জেলেও যেতে হয়েছিল তাঁকে। মুক্তি পেয়েছেন ১২ দিন পর। ‘আওয়াজ উডা’ গান, জেলজীবন ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলেছেন এই গায়ক।

কোন ভাবনা থেকে ‘আওয়াজ উডা’ গানটি লিখেছিলেন?

আন্দোলনে আমার ভাইবোনদের রাস্তায় মারা হচ্ছিল। আবু সাঈদের মতো অনেক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সেই সময় আর চুপ থাকার অবস্থায় ছিলাম না। ভাবছিলাম আমার অবস্থান থেকে কিছু একটা করার। সেই চেষ্টা থেকেই ‘আওয়াজ উডা’ গানটি লিখেছিলাম।

কখনও কী ভেবেছিলেন গানটি আন্দোলনরতদের প্রেরণা জোগাবে?

দেখুন, যে কোনো প্রতিবাদী গান মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম হাতিয়ার গান। তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭১। যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত গানগুলো মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা জুগিয়েছে; যা ছিনিয়ে এনেছে আমাদের স্বাধীনতা। এবারও ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও গান যে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তার প্রমাণ পেয়েছি গানটি দিয়ে। যখন আমি গানের বিট নিয়ে বসেছিলাম একটি শব্দের পর আরেকটি শব্দ অটোম্যাটিক চলে আসছিল। যখন ফাইনাল হলো তখন দেখি অনেক দিক থেকে সীমা অতিক্রম করেছিল। তখনই বুঝিছি ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় এটি লিখেছিলাম। গানটি বের হওয়ার দু’দিন পরই জেলে যাই। ছাড়া পেয়ে বুঝতে পেরেছি শ্রোতারা গানটি কতটা গ্রহণ করেছেন।

কারাগারের দিনগুলো কেমন ছিল?

আদালতে নেওয়ার আগে থানায় ৩৯ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। আমার পরিবারের লোকজন তখন কিছুই জানত না। আদালতে পাঠানোর আগেও আমি জানতাম না, আমাকে কী অভিযোগে এখানে আনা হয়েছে। পরে জেনেছি, আমার বিরুদ্ধে নাকি ভাঙচুর, বিস্ফোরণের মামলা দেওয়া হয়েছে। যখন আমাকে কারাগারে নিয়ে আসা হয় তখনই বুঝে গিয়েছিলাম এখানে আমাকে কিছুদিন থাকতে হবে। বাকি দিনগুলো খুব কষ্টে কাটবে। প্রথম কয়েকটা দিন ছিল খুবই দুঃসহ। আমাকে টাওয়ারে রাখা হয়েছিল। বাইরে বের হওয়ার উপায় ছিল না। পরে টাওয়ার থেকে নামিয়ে বাইরের সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ছোট একটা রুমের মধ্যে আমার সঙ্গে দু’জন ছিল। জেলের ভেতর বাইরের কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। প্রথম জেলজীবন। ১৩ দিন কতটা কষ্টে জেলে ছিলাম তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কেমন লেগেছে?

শেখ হাসিনার পতনের পর জেল থেকে বের হয়েছি তাই মনে অনেক বল ছিল। ভয়ডর উবে গিয়েছিল। মনে হলো মুক্ত দেশে পা রেখেছি। জেলে থাকালীন শিল্পীসহ নানা শ্রেণির মানুষ আমাকে মুক্ত করার জন্য কর্মসূচি নিয়েছিলেন। অনেকের আইনি সহায়তা পেয়েছি। অনেকে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি করেছেন। কেউ কেউ ব্যানার নিয়ে মিছিলও করেছেন। সবাই আমার জন্য এত কিছু করেছেন আমি যখন জানতে পেরেছি, আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে র্যা প গান করতে পরিবার থেকে কতটা উৎসাহ পেয়েছিলেন?

পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে খুব যে উৎসাহ পেয়েছি তা নয়। তবে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। বাবা মাঝে মাঝে বকা দিতেন। এগুলো ছেড়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলতেন তিনি। যখন পরীক্ষায় ফলাফল ভালো করেছি তখন গান নিয়ে কিছু বলতেন না।

কারাজীবন নিয়েও নাকি গান করেছেন?

হুম, কারাজীবন নিয়েও একটা গান করছি, অর্ধেকটা লেখা হয়েছে। কারাগারে থাকতেই গানটির কথা ভেবেছি। শিগগিরই এটি প্রকাশ করব বলে ভাবছি। এ ছাড়াও ‘হরেক মাল’ নামে একক অ্যালবাম করার ইচ্ছা রয়েছে। এটি আমার প্রথম একক অ্যালবাম।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

মুক্ত বাতাসে আছি এটাই ভালো লাগছে। সবাইকে সবার হক দেওয়া হোক। আমরা লিখি। আমাদের মন খুলে লিখতে দেওয়া উচিত। গায়কদের গাওয়ার হক দেওয়া হোক। মুক্ত বাংলাদেশ আজীবন মুক্ত থাকুক। স্বাধীন দেশের নাগরিকদের যেমন থাকা উচিত আমাদের সেভাবে থাকতে দিতে হবে–মনেপ্রাণে এটাই চাওয়া।

বার্তাবাজার/এমআই