ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারত পালিয়ে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় টানা ১৬ বছর হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন প্রশাসন। সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন। সব জায়গাতেই হাসিনার স্বৈরাচারী আচরণ ছিল স্পষ্ট। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা হলেও ঘুরে ফিরে তারাই বিভিন্ন সেক্টরে বসছেন, যারা আগের সরকারের ঘোর সমর্থক ও সুবিধাভোগী। এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর তকমা রয়েছে। বিপরীতে বিগত ১৬ বছর যাদের পদোন্নতি হয়নি তারা এখনো অবহেলিত বলে অভিযোগ রয়েছে।

চাহিদার আলোকে পরিবর্তন না হওয়াতে সচিবালয়ে ক্যু-এর আশঙ্কা করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।

এমতাবস্থায় সচিবালয় এবং জেলা প্রশাসনের কাজ অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে, ফলে ক্ষোভ বাড়ছে বিভিন্ন মহলে।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেসব জেলায় প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই বিরুদ্ধে এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, মাঠ প্রশাসনে যাদের জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী।

একটি সূত্র বলছে, গত সোমবার ডিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী এবং ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার অন্তত ১০ জনের নিয়োগ বাতিল করেছিল। অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আবারও ছাত্রলীগের নেতারাই ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় বিশৃঙ্খলা তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন শেরপুরের জেলাপ্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান (১৬১২৯)। সাবেক আইন বিচার ও লেজিসলেটিভ সচিব মইনুল কবিরের পিএস ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

নাটোরে নিয়োগ পেয়েছেন রাজীব কুমার সরকার (১৬০৫৪)। তার শ্বশুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, কামাল আব্দুল নাসেরের (সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের মুখ্য সচিব) ব্যক্তিগত লোক রাজীব সরকার।

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন খন্দকার ইশতিয়াক (১৫৮৮১)। দীর্ঘদিন থেকে মন্ত্রী পরিষদে অর্থাৎ পাঁচ বছরের বেশি সময় কর্মরত আছেন তিনি। আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজশাহীর ডিসি হিসেবে পদায়িত মাহবুব রহমান আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ইতোমধ্যে বিগত সরকারের সময় (০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১) তার একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে তিনি লিখেছেন, “we all are sheikh Hasina’s men”। তার নিয়োগ আজ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

⁠২৭ ব্যাচের মোবাশশ্বেরুল ইসলাম পোস্টিং পেয়েছেন দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে। তিনি ছিলেন সাবেক পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের পিএস। তার নিয়োগ আজ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

আরও প্রায় এক দশক ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে একসময় জড়িত ছিলেন অথবা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী।

এদিকে এসব বিষয় সামনে আসায় মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভ–হট্টগোল হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছ থেকে দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিলের আশ্বাস পেয়ে সচিবালয় ছাড়েন নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা কর্মকর্তারা।

এর পর মঙ্গলবার রাতেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে পদায়ন করা জেলা প্রশাসকগণের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া হয়।

যেখানে বলা হয়েছে, ৯ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপনে পদায়নকৃত জেলা প্রশাসকগণের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

১। বুধবার মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, তেজগাঁও এ অনুষ্ঠাতব্য ব্রিফিং অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হয়েছে।

২। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সবাইকে পদায়নকৃত কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা না করে ঢাকায় অবস্থান করতে হবে।

মূলত নিয়োগ করা ডিসিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের নিয়োগ বাতিল করতেই মঙ্গলবার এই নোটিশ দেওয়া হয়।

এদকে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ৫৯ ডিসির মধ্যে ৮ জনের নিয়োগ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সচিবালয়ে বিক্ষোভের মধ্যেই বুধবার সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেসউর রহমান ওই ৮ জনের নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।

সিনিয়র সচিব বলেন, একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে ফিটলিস্ট হয়। সেই কমিটি আজ বৈঠকে বসেছিল। পর্যালোচনা করে ৮ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

বাতিল হওয়া ৮ জেলার মধ্যে রয়েছে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, শরিয়তপুর ও লক্ষ্মীপুর।

এর আগে গত সোম এবং মঙ্গলবার দুদিনে দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল করেন উপসচিব পর্যায়ের একদল কর্মকর্তা।

বার্তাবাজার/এমআই