সেদিন শুক্রবার। জুমার নামাজে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বের হয় ৬ বছরের মুরসালিন। সেই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হবে– ঘুর্ণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি মা রুবিনা বেগম। পাঁচ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁর বুকের মানিক মুরসালিন আর ফেরেনি।

ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আশায় আছেন– এই বুঝি মুরসালিন এসে ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরবে।মুরসালিনের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার সাজাইল ইউনিয়নের আমডাকুয়া গ্রামে। মো. বাচ্চু সরদার-রুবিনা বেগম দম্পতির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সে ছোট।

২০১৯ সালের ২ আগস্ট নিখোঁজ হয় মুরসালিন। সে পড়ত সাজাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে। সেদিনই কাশিয়ানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রুবিনা বেগম।

ছেলে উদ্ধার না হওয়ায় ১৯ আগস্ট চারজনের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ এনে মামলা করেন বাচ্চু সরদার। আসামিরা হলেন– বেদেনা, রাসেল শেখ, আসাদ মুন্সী ও হারুন সরদার।এজাহারে বলা হয়, ২ আগস্ট দুপুরে মুরসালিন বাড়ির পাশে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিল সে। পথে সাজাইল পুরোনো ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কাছে পৌঁছানোর পর সাদা একটি মাইক্রোবাসে মুরসালিনকে তুলে নেয় অজ্ঞাতপরিচয় ৫-৬ জন।

তারা দ্রুতগতিতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দিকে চলে যায়। শনিবার আমডাকুয়ায় মুরসালিনের বাড়িতে কথা হয় মা রুবিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। বেঁচে আছে, না তাকে হত্যা করা হয়েছে– কিছুই জানি না। অনেক জেলায় খুঁজেছি। পুলিশও আমার ছেলের খোঁজ দিতে পারেনি।’রুবিনা বলেন, ‘আমার বুকের ধন, এক দিন আমার বুকে ফিরে আসবে– আমাকে মা বলে ডাকবে; সেই আশায় আমি এখনও বুক বেঁধে আছি।

যে কোনো কিছুর বিনিময়ে সন্তানকে ফিরে পেতে চান তিনি।জানা গেছে, মুরসালিনকে অপহরণের অভিযোগে মামলা হওয়ার পর পুলিশ আসাদ মুন্সী (৬০) ও হারুন সরদার (৫৭) নামের দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

তাদের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে কাশিয়ানী থানা পুলিশ। আদালত তাদের কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। পরে আদালত মামলাটি অধিক তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন। যদিও পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি পুলিশ। একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। বাচ্চু সরদারের ভাষ্য, গ্রেপ্তার আসামিরা জামিনে এসে ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর ওপর হামলা করে।

তাঁকে পিটিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় ৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও করেন। কিন্তু উল্টো আসামি পক্ষ ২০২০ সালের এপ্রিলে একটি হত্যা মামলায় তাঁকে আসামি করে। বাচ্চু সরদারের অভিযোগ, তাঁর ছেলে অপহরণে জড়িতদের হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী, কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান কাজী জাহাঙ্গীর আলম কাজ করেন। তাদের চাপে মামলা নিতেও পুলিশ গড়িমসি করে।

এসব কারণেই তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো বিচার পাইনি। ক্ষমতাসীন নেতারা প্রভাব খাটিয়ে মামলাটি ভিন্নভাবে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।’ তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে ন্যায়বিচারের প্রাপ্তির আশায় নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছেন সিআইডির এসআই মো. ফারুক হোসেন চৌধুরী। তিনি সমকালকে বলেন, ‘ওই মামলার তদন্ত কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু পাইনি। পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেওয়া হবে।’