ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলতি আমন মৌসুমে ধানের চারা বিক্রির হাটটি জমে উঠেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জেলার সদর উপজেলার কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে নন্দনপুর এলাকার বৃহৎ হাটটিতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের ধানের চারা ক্রয়-বিক্রয় করছেন। চারা ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় চারার হাটটি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মুখরিত থাকে।
সরজমিনে বাজার ঘুরে দেখা যায়, জেলার সদর উপজেলার কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে নন্দনপুর এলাকার মৌসুমি চারার হাটটি বেশ পুরাতন। আমন মৌসুমে এই চারার হাটটি ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারনায় বেশ জম জমাট। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে তাদের পছন্দ মত চারা দেখে দাম বলছেন। বিক্রেতারাও তাদের চারা প্রকারভেদ অনুযায়ী দাম চাচ্ছেন। এই হাটে চারা আটি ভেদে বিক্রি করা হয়। ছোট চারার আটি প্রকারভেদে ৮০ টাকা থেকে ১২০ ও বড় চারার আটি প্রকারভেদে ২০০-২৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতারা তাদের পছন্দ মত চারা কিনে তাদের পছন্দ মত বাহনে করে নিয়ে যাচ্ছেন। এই চারার হাটে বিভিন্ন জাতের ধানের চারা বিক্রি হয়ে থাকে, এর মধ্যে বিআর-২২, খাসা, নাজির, ও বিনা ধান-৭ অন্যতম। জেলাসহ আশপাশের জেলা থেকে আসা কৃষক পাইকাররা এই ধানের চারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন।বাজারে আসা ক্রেতারা জানান এই হাটে চাহিদা অনুযায়ী কাঙ্খিত চারা পেয়ে বেশ খুশি। দাম নিয়েও সন্তুষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতারা। অন্য দিকে বিক্রেতারা বলছেন বিক্রিও ভাল হচ্ছে, সামনের দিন গুলোতে যদি এমন ভাবে চারা বিক্রি হয় তাহলে তারা লাভবান হবেন।
জেলার সদর উপজেলার মজলিশপুর এলাকা থেকে চারা কিনতে আসা ক্রেতা রমজান মিয়া নামের কৃষক জানান, প্রতি বছরই এই হাট থেকে ধানের চারা (জালা) কিনে থাকি। বিআর-২২ জাতের ২০ মোটা চারা ১৫০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। ১ কানি (৩০শতাংশ ১ কানি) থেকে একটু বেশি জমিতে এই চারা গুলো বপন করতে পারব। গত বছর থেকে এবার দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এই বাজারের চারার মান অনেক ভালো। চারা ভালো হলে ধানের উৎপাদন ও ভালো হয়। জেলার কসবা উপজেলার ক্রেতা শাহ আলম বলেন, আমন মৌসুমে এই অস্হায়ী চারার হাটটি জমে। আশপাশের বিক্রেতারা এখানে চারা বিক্রি করে থাকে। তার ৬ কানি জমির জন্য একান থেকে চারা কিনবেন। ২৮ মোটা বিআর-২২ জাতের চারা ২৮২০ টাকা দিয়ে কিনেছেন। দেড় কানির মত জমিতে এই চারা রোপন করা যাবে। কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই নিজের পছন্দ মত চারা কিনতে পেরে খুশি।
জেলার হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর এলাকা থেকে চারা কিনতে আসা সুজন চৌধুরি বলেন, তিনি দুই কানি জমির জন্য চারা কিনবেন।চারা বিক্রেতারা প্রভারভেদ অনুযায়ি চারার দাম চাচ্ছেন। চারার দাম মোটামুটি, আমাদের নাগালেই মধ্যেই। চারার আটি প্রকারভেদে ৮০ টাকা থেকে ১২০ ও বড় চারার আটি প্রকারভেদে ২০০-২৫০ টাকা দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা। এই চারার হাটে কোন দালাল চক্র নেই। মহাসড়কের পাশে বাজারটি হওয়ায় যানবাহন খুব সহজে পাওয়া যায়। হাটে চারা বিক্রি করতে আসা সদর উপজেলার চান্দিয়ার এলাকার বিক্রিতা খুরশেদ ইসলাম বলেন, এবার ২ কানি জমিতে ধানের চারা চাষ করেছি। চারা ভালোই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি আটি প্রকার ভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এই হাটে বিআর-২২, খাসা, বিনা ধান-৭সহ বিভিন্ন জাতের ধানের চারা বিক্রি হয়ে থাকে। বিক্রি বেশ ভালোই হচ্ছে, আগামী দিন গুলোতে এমন বিক্রি হলে ভালো লাভবান হবো। তিনি আরো জানান, এই হাটে জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকসহ পার্শ্ববর্তী জেলার কৃষকেরা চারা ক্রয় করতে আসেন।
আরেক বিক্রেতা সদর উপজেলার সুহিলপুরের কঞ্চন দাস বলেন, আমন মৌসুমে এই অস্হায়ী হাটটি বেশ জমজমাট থাকে। এই হাটে যে কেউ চারা বিক্রি করতে পারে। চারার হাটটি কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে হওয়ায় ক্রেতা সহজে চারা কিনে পছন্দ মত বাহনে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি আরো জানান, তিনি দেড় কানি জমিতে চারা রোপন করেছেন। দেড় কানি জমিতে তার চারা রোপন করতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি জমিতেই ৪৫ হাজার টাকা পাইকারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই চারার হাটে প্রকারভেদ অনুযায়ী চারার হাটি বিক্রি হয়ে থাকে। এবারও চারার ক্রেতার সমাগম অনেক ভাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মুনসী তোফায়েল হোসেন জানান, নন্দনপুর চারার হাটটি অনেক পুরাতন। নন্দনপুরের প্রতিদিন এই হাটে মান সম্মত চারা পাওয়া যায়। এখানে কৃষকেরা বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করে থাকে।এই চারা জেলার বাহিরে (সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ ও নরসিংদী) জেলার কৃষকদের কাছে চাহিদা রয়েছে।
তিনি জানান, সম্প্রীতি ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার কসবা, আখাউড়ায় ও বিজয়নগরে বন্যায় চারা ক্ষেতগুলো ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে নন্দনপুর হাট থেকে চারা ক্রয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নন্দনপুরে যারা চারা বিক্রি করে সে সকল কৃষকের মোবাইল নম্বর, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে কোন কৃষক চারা পেতে অসুবিধা না হয়। বন্যার কারণে যাতে কোন জমি খালি না থাকে, যাতে কেউ চারা সংকটে না পড়ে। এই বাজারে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার চারা বিক্রি হয়ে থাকে। এই বছর প্রায় ২ কোটি টাকার চারা বিক্রি হবে বলে আশা করি।
তিনি আরো জানান, জেলায় চলতি আমন মৌসুমে ২’হাজার ৭’শ ৯৪ হেক্টর জমিতে ধানের চারা বীজতলা রূপনের লক্ষ্য মাত্রা ছিল। আবাদ হয়েছে ৩’হাজার ১’শ ৩২ হেক্টর। বন্যায় ৩’শত৭৪ হেক্টর জমির চারা ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে। তিনি আরো জানান, কৃষকেরা নিজের জমির পাশাপাশি বাজারে বিক্রির জন্য অতিরিক্ত কিছু চারা রোপন করেন। এবার আমাদের রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৪ হাজার ৪’শ ২৫ হেক্টর। এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৪১ হাজার ৬’শত হেক্টর। বন্যায় প্রায় ৬ হাজার ৯’শত ৭৬ হেক্টর জমির চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি রোপা আমন মৌসুমে জেলায় ১’লাখ ৭৫’হাজার ৯২৮ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।