বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ২ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার করা যায়নি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল গোলাবারুদ। গত বুধবার থেকে শুরু হওয়া যৌথ বাহিনীর অভিযানে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৫৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫ জন সন্ত্রাসীকে। এছাড়া আওয়ামী লীগের আমলে লাইসেন্স পাওয়া ১ হাজার ৬৫৪টি অস্ত্র নির্দিষ্ট সময়ে থানায় জমা পড়েনি।
লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে থাকায় কি নিরাপত্তাসংকট বাড়ছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন যে উদ্ধার হয়নি, সেটা তো উদ্বেগের। এছাড়া গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে এসএসএফের যে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে, সেগুলো তো কোনোভাবেই সাধারণ নাগরিকের কাছে, এমনকি পুলিশের কাছে থাকাও উচিত নয়। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়।’
সাতক্ষীরা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবির বাড়িতে শুক্রবার গভীর রাতে অভিযান চালিয়েছে যৌথ বাহিনী। এ সময় বাড়িতে কেউ ছিলেন না। সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। তবে তল্লাশি করে রাইফেলের তিনটি বাঁট, একটি চাইনিজ কুড়াল, দুটি হাতুড়ি, একটা ভিডি, দুই সেট ওয়াকিটকি, ৪৮টি খালি কার্তুজ, একটি শটগানের কভার ও চারটি পিস্তলের কভার উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেছে।
ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট নেত্রকোণার পূর্বধলার শ্যামগঞ্জ বাজারে পুলিশের গাড়িতে হামলা হয়। ঐ ঘটনায় ১০টি নাইন এমএম পিস্তল, ২৬টি ম্যাগাজিন, ৪২০ রাউন্ড পিস্তল অ্যামোনিশন, ৪০ রাউন্ড রাইফেল অ্যামোনিশন ও ৩২টি টিয়ার গ্যাস শেল লুট হয়। যৌথবাহিনীর অভিযানে নেত্রকোনার পূর্বধলা থেকে নারীসহ পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৯টি উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া একটি অস্ত্রের ভাঙা অবস্থায় অর্ধেক অংশ পূর্বধলার সোয়াই নদী থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে।
গত ২০ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ৯ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোদ্ধারা। এদের মধ্যে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি পাঁচ জন এখনো পলাতক। ঐ সময় কারাগার থেকে বেশ কিছু অস্ত্র লুট হয়, পালিয়ে যায় প্রায় ৯ শতাধিক আসামি। লুট হওয়া ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ২০টি চায়না রাইফেল, ১৫টি রাইফেল এবং ১০টি শটগানসহ ৪৫টি অস্ত্র, ১ হাজার ৯১টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ১৮৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশের সহায়তায় পালিয়ে যাওয়া ৪৮১ জন কয়েদি আত্মসমর্পণ করেছেন। এখনো পলাতক রয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক বিভিন্ন মামলার আসামি।
এসব আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকা কতটা নিরাপদ? জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘অবৈধ কোনো আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকা ঠিক না। এর কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে কোনো সময় অবনতি হতে পারে। এই মুহূর্তে সরকারের কাজ হবে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে মনোযোগ দেওয়া। পাশাপাশি যেসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা পালিয়ে গেছেন তাদের গ্রেফতার করতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার জন্য সরকারের বারবার আহ্বান জানালেও এখনো ৩ লাখেরও বেশি গুলি এবং প্রায় ২ হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এগুলো উদ্ধারে বুধবার থেকে অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে সরকার।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ঐ সময় ৫ হাজার ৮১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র খোয়া যায়। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯০টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। যদিও গত চার দিনে যৌথ অভিযান ৫৩টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে রিভলভার দুটি, পিস্তল ১৮টি, রাইফেল দুটি, শটগান ১১টি, পাইপগান একটি, শুটারগান ছয়টি, এলজি তিনটি, বন্দুক তিনটি, একে-৪৭ একটি, গ্যাসগান একটি, চাইনিজ রাইফেল একটি, এয়ারগান একটি ও এসবিবিএল তিনটি। গ্রেফতার হয়েছেন ২৫ জন।
এছাড়া ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর গণভবনের দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্য পালিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচ মিনিট সময় পেয়েছিলেন। ফলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তারা নিতে পারেননি। বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্টিক্যাল গিয়ার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম, বেতার যোগাযোগ ও অপারেশনাল সরঞ্জামাদির মজুত ছিল এসএসএফের। কিন্তু, হাতে সময় একদমই না থাকায়, এসব ফেলে শুধু নিজেদের সঙ্গে থাকা ছোট আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিভিন্নভাবে গণভবন থেকে সংসদ ভবনে গিয়ে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করেন তারা। জনতা যখন সংসদ ভবনেও ঢুকে পড়ে, তখন এসএসএফ সদস্যরা দ্রুত নিজেদের অস্ত্র ও পোশাক খুলে সংসদ ভবনের ভল্টে রেখে সাধারণ পোশাকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে প্রাণরক্ষা করেন। পরবর্তীকালে পরিদর্শন করে গণভবন ও সংসদ ভবনে থাকা ভল্টগুলো আর পাওয়া যায়নি। অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ খোয়া গেছে, যার মূল্য ৫ কোটি টাকারও বেশি। গণভবনে এসএসএফের স্থাপিত অপারেশন রুমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার জন্য দুটি অত্যাধুনিক ভল্ট স্থায়ীভাবে স্থাপন করা ছিল, যার প্রতিটির ওজন ১০০ কেজি। একটি ভল্টে দুটি এসএমজি টি-৫৬ রাইফেল ছিল এবং অপর ভল্টে ৯ হাজার ৪৯৮ রাউন্ড তাজা গুলি ছিল। দুর্বৃত্তরা ঐ ভল্ট দুইটি নিয়ে যায়।
এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে পুলিশ কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে? জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, ‘এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের জন্য যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এই যৌথ অভিযানে পুলিশ ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব ও আনসার সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন। তবে যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ খোয়া গেছে, সেগুলো উদ্ধার করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা চেষ্টা করছি।’
এদিকে এসব অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে গত ১৫ বছরে বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রও। যার বেশির ভাগই রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে। গত মঙ্গলবারের মধ্যে গোলাবারুদসহ এসব আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বেঁধে দেওয়া সময় শেষেও অনেকে অস্ত্র জমা দেননি। জানা গেছে, দেশের আট বিভাগে ৯ হাজার ১৯১টি বৈধ অস্ত্র থানাগুলোতে জমা পড়েছে। বাকি ১ হাজার ৬৫৪টি জমাযোগ্য বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়া হয়নি।
বার্তাবাজার/এমআই