কয়েক বছর আগেও এই মাছের তেমন কদর ছিল না। জেলেসহ উপকূলীয় মানুষ একসময় ফেলে দিত এই মাছ। দেশ-বিদেশে মাছটি খাবার হিসেবে শুধু শুঁটকির তালিকায় স্থান পেত। সেই মাছটি এখন প্রতিনিয়ত বাজারজাত হচ্ছে। তাজা মাছই এখন সবার পছন্দের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
সামুদ্রিক লইট্টা মাছের কথা বলছি, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Bombay Duck। একসময় শুধু শুঁটকির চাহিদা পূরণে জোগান দিয়ে এলেও এখন কদর বেড়েছে তাজা লইট্টার। দাম কম হওয়ার পাশাপাশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও স্বাদও বেশ এই মাছের।
কুয়াকাটার বিভিন্ন হাট-বাজারসহ উপকূলের মৎস্য আড়তপট্টি এখন লইট্টা মাছে সয়লাব। জেলে, ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন এই মৌসুমের। মূলত ভাদ্র থেকে পুরো শীত মৌসুম এই মাছের দেখা মেলে সামুদ্রিক জেলেদের জালে। বিশেষ করে এ মাছের শুঁটকির চাহিদা বেশি হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কয়েক মাস ধরে লইট্টা মাছ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে বছরব্যাপী বাজারজাত করে থাকেন।
উপকূলের মানুষেরা একসময় এ মাছের প্রতি গুরুত্ব না দিলেও বর্তমানে লইট্ট্যার ব্যপক চাহিদা। দুই বছর আগেও লইট্ট্যা মাছ খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি বিক্রি হতো ২০-৩০ টাকা। কিন্তু সারা দেশে তাজা ও শুঁটকি লইট্টার ব্যপক চাহিদার কারণে এর দর বেড়েছে। গত বছর থেকেই খুচরা পর্যায়ে তাজা লইট্টা মাছ বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৩০ টাকায়।
এদিকে ইলিশের ভরা মৌসুমেও উপকূলীয় কুয়াকাটা জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না রুপালি ইলিশ। চলমান মৌসুমে শুধু লইট্টা মাছের উপস্থিতি বেশি। মাছের বাজারে লইট্টার বিপুল সমারোহ।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুয়াকাটা, আলীপুর, মহিপুর, কলাপাড়ার মৎস্য আড়তপট্টিতে শুধুই লইট্টা মাছের উপস্থিতি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমুদ্রগামী ট্রলার থেকে নামছে খাঁচা ভর্তি লইট্টা মাছ। ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা মণ দরে ডাকের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে এসব মাছ। পাইকাররা কিনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন মোকামে।
স্থানীয় মাছের বাজারে ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ মাছ ব্যবসায়ী প্রতি কেজি লইট্টা মাছ বিক্রি করছেন ১০০-১৩০ টাকা দরে। কখনো কখনো এর চেয়ে কম দরেও বিক্রি করেন বলে জানান স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীরা।
কুয়াকাটা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আলামিন হাং বলেন, ‘ইলিশ মাছ না পেয়ে লইট্টা মাছ ডাকের মাধ্যমে কিনে এনে খুচরা বাজারে কেজি দরে বিক্রি করি। সব জায়গায় লইট্টা মাছ। মণ ৪-৫ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকা দরে বিক্রি করি।
সাগরে জাল ফেললেই এখন লইট্টা মাছ ধরা পড়ে বলে জানান মায়ের দোয়া ফিশিং বোটের মাঝি আলী আহমেদ। বলেন, ‘লইট্টা মাছের কারণে জাল ভারী হয়ে পড়ে। এই মৌসুমে লইট্টা মাছ আমরা বেশি পাই। আগে এই মাছ আমাদের এখানকার কেউ খেত না। এখন তাজা ও শুঁটকির চাহিদা পূরণে লইট্টা মাছের দাম বেড়েছে।
আলীপুর মৎস্য বন্দর ট্রলার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ও মেসার্স মনি ফিশের ব্যবস্থাপক মো. জলিলুর রহমান বলেন, মৌসুমের শেষের দিকে এসেও মিলছে না ইলিশ মাছ। ট্রলার ভর্তি ঘাটে আসছে লইট্টা ও অন্যান্য মাছ। এখন এক-একটা ট্রলারে ৩০-৪০ মণ লইট্টা মাছ পাওয়া যায়। আগে কদর না থাকলেও এখন লইট্ট্যা মাছের চাহিদা বেড়েছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, সমুদ্রে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আশা করা হচ্ছিল জেলেরা প্রচুর ইলিশ নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তাদের ফিরতে হচ্ছে অন্যান্য মাছ নিয়ে। তবে এ মৌসুমে লইট্টা মাছের উপস্থিতি বেশি। দাম কম হওয়ায় চাহিদাও ভালো।
লইট্টা মাছের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা যায়, তাজা ও শুঁটকি দুই ধরনের মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অত্যাবশ্যক মৌল উপাদান রয়েছে। তাই নিয়মিত এই মাছ খেলে অস্টিওপোরোসিস ও আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি সমস্যা দূর করে। এই তাজা মাছ ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, চোখের নিচে কালচে ভাব, চুল পড়ে যাওয়া, রুক্ষ চুলের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। শরীরের হরমোন, এনজাইম এবং বিভিন্ন ক্যামিকেলের ভারসাম্য রক্ষা করে।
উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকায় মানুষের শরীরের রক্তনালী পরিষ্কার রেখে হার্ট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। মাংসপেশির স্বাভাবিক সংকোচন-প্রসারণের সাহায্য করে এটি। তাছাড়া আয়োডিন সমৃদ্ধ হওয়ায় থাইরয়েড রোগীর জন্য এই মাছ খাওয়া উপকারী।
লইট্টা মাছে প্রোটিনে ভরপুর, যখন মাছ শুকানো হয় তখন এই প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, আর এই প্রোটিন মানুষের শরীরের টিস্যু গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে বলে রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়ক এবং রক্তাল্পতার মোকাবিলা করে।