ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব।
গতকাল শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় আসিফ মাহতাব বলেন, ‘একটা টাইমে আন্দোলন দমে যাচ্ছিল, তখন সাদিক ভাই আমাকে বললেন, ‘‘আমরা কী করতে পারি এখন। আপনাকে (আসিফ মাহতাব) ধরলে এখন আন্দোলন চাঙ্গা হতে পারে।’’ আমি বললাম, ‘‘আমাকে ধরা বোকামি হবে। আমাকে ধরলে জনগণ আন্দোলন করবেই। আওয়ামী লীগ এত বড় বোকামি করবে না। আমাকে যদি ধরে ব্যবস্থা করব”।
আটকের দিনের বর্ণনা দিয়ে আসিফ মাহতা বলেন, ‘রাজাকার, লীগার হানাদার আসছে। আমি আসলে ঘুমের মধ্যে ছিলাম, এজন্য বুঝতে পারিনি এটা একটা ট্র্যাপ ছিল। এরপর আমি বাসার দারোয়ানের কাছে যেতেই সাথে সাথে কয়েকজন হানাদার লীগার বাহিনী ঢুকে পড়ল। আমি তো মানিসকভাবে প্রস্তুত। তখন আমি তাদের বললাম, ‘‘আপনারা দাঁড়ান, আমি কাপড় নিয়ে আসতেছি।’’ তখন আমি আমার বোনের রুমে যায়। ওর চুল ধরে টান দিলে ও উঠে পড়ল। তখন আমি বললাম, ‘‘দে আর হেয়ার (ওরা আসছে)। তোমার এখন কী করতে হবে সেটা তুমি জানো।’’ বোনের সাথে এই শেষ কথা। এরপর আমি ওদের সাথে চলে গেলাম। ওরা আমার বাসার সব সিসি ক্যামরা বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু একটি ক্যামেরা অন ছিল। ওরা সেটা বোঝে নাই।’
আসিফ বলেন, ‘প্রথম দিন রাতে তারা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু পারেনি। এরপর তারা আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে গেলেন। ওখানে যে অবস্থা, ভয়ংকর অবস্থা। ৮০-১০০ জনের মতো লোক, ছোট্ট একটু স্পেসে আটকে রেখেছে। কেউ বসলে, কেউ শুয়ে থাকে, কেউ শুয়ে থাকলে, কেউ বসে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘ওখানে এশিয়ান ইউনির্ভাসিটির একজন প্রফেসর ছিলেন, তিনি শোয়ারই চান্স পান নাই। তিনি বসেই ছিলেন। ওইখানে ঢুকে প্রথম দিনেই তো অবস্থা খারাপ। এমনি তো আমার স্পাইনের সমস্যা। এই সমস্যার কারণে আমি এমনি সব সময় পেইনে ভেতরে থাকতাম। ফিজিওথেরাপি করলে কমে, না হলে বেড়ে যায়। সেই সিচুয়েশনের আমাকে নিয়ে গেল, যোখানে বসার জয়গায় নেই। সেখানে শত শত মানুষ। সেখানে প্রথম রাত ছিলাম। এরপর তারা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ওপরে। তারপর তারা আমাকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার ব্র্যাকে কয়জন শিবির আছে।” তখন আমি বললাম, ‘‘আমি তো শিবির করি না। আমি কীভাবে জানব সেখানে কতজন শিবির আছে।” এ রকম অনেক প্রশ্ন করল বারবার। তারপর ওয়ান পয়েন্টে হানাদার লীগার বাহিনীর একজন বললেন, ‘‘আপনি যে কোটা নিয়ে এত কথা বলেন, বলেন তো কোটার পদ্ধতি কী, বিসিএসে সিলকশন প্রসেসটা কী।’’ আমি তখন আসলে বলতে পারিনি। কারণ আমি তো মেন্টালি তো ওই লেভেলে নেই।’
আসিফ মাহতাব বলেন, ‘এরপর তারা আমাকে ধাক্কা দিল। তারপর আমার মুখে হিট করা শুরু করল। ৬টা হিট করার পরে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘‘নো নো”। পরে আবার হিট করা শুরু করে। এরপর তারা বলল, “আপনি তো খুব খারাপ জায়গায় আসছেন। আপনার তো বাঁ পায়ে প্রবলেম, আপনার ডান পা আমার ভেঙে পুরো লুলা বানায় দেব।’’ এরপর একজন লাঠি নিয়ে আসল, তবে তারা লাঠি দিয়ে হিট করেনি। এরপর তারা আমাকে সেই আগের জায়গায় নিয়ে গেল।’
আসিফ বলেন, ‘এরপর আরেকটা সমস্যা ওই খানে ৮০-১০০ জনের একটি টয়লেট। এমনিতে আমার স্পাইনের সমস্যার কারণে হাইকমোড ব্যবহার করতে হয়। ৮০-১০০ জন যেখানে একটি টয়লেট ব্যবহার করে সেখানে কী অবস্থা হতে পারে তা আপনারা বুঝতে পারছেন। এরপর আমি খাওয়া কমিয়ে দিলাম। যাতে টয়লেটে না যাওয়া লাগে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে টয়লেটে তারা সাবান ও দেয় না।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি দিন তারা নাম-বাবার নাম ডেকে কল করে। এরপর তারা চোখ মুখ বেঁধে নিয়ে যায়। তারপর হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে পেটায়। বিভিন্নভাবে টর্চার করে। ওখানে সবার সাথেই এমনটা হয়েছে। স্পেশালি যারা জামায়াতের লোক স্বীকার করেছে, তাদের অমানবিকভাবে টর্চার করা হয়েছে। ওখানে নূর ভাইয়ের সাথে দেখা, তাকে বললাম, ভাই কী অবস্থা, তখন নূর বলল, ‘‘ভাই আমাকে তো অনেক মারছে।’’
আসিফ বলেন, ‘এরপর আমি ওখানে সবাইকে মোটিভেশন দেওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে একটা ছেলে সে বলে, ‘‘আমি তো স্যার কিছু করি নাই। আমি তো ইলেকট্রিকের কাজ করি। তারপর আমাকে ধরে নিয়ে আসছে স্যার। আমাক টর্চার করছে। স্বীকার করতে বলতেছে, আমি খুন করেছি।” তখন আমি তাকে বললাম, “তুমি স্বীকার করবা না। তোমার পা যদি কেটেও ফেলে তাও তুমি স্বীকার করবা না।” তবে আমাকে প্রথম দিন যেভাবে টর্চার করেছে, এরপর কোর্টে চালান দেওয়ার পর আমাকে আর সেভাবে টর্চার করেনি। তবে আমি বিভিন্ন সময় ইনফরমেশন পাচ্ছিলাম, যারা আমাকে ধরে নিয়ে আসছিল, তাদের একজনের কাছে শুনেছিলাম, কয়েজন ডিবি বলাবলি করছিল, “এই লোককে কেন তুলে আনা হয়েছে। এটা তো ঠিক হয় নাই”।’
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ২৮ জুলাই রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ায় আসিফ মাহতাবকে। রাজধানীর সেতুভবনে আগুন দেওয়ার মামলায় তাকে আসামি করা হয়। এ মামলায় ২৯ জুলাই ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হলে ৩ আগস্ট কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর গত৬ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন।