ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে আন্দোলন শুরু হয় কোটা সংস্কার নিয়ে। আর তা শেষ পর্যন্ত গড়ায় সরকার পতনের আন্দোলনে। নানান চড়াই-উতরাই শেষে এ ছাত্রদের হাত ধরেই আসে জনতার বিজয়। এ বিজয় উপাখ্যান লিখতে হারাতে হয়েছে বহু প্রাণ। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মতো শত শত ছাত্র-জনতার বুক। শত নির্যাতন-নিপীড়ন শেষে এ ছাত্রদের হাত ধরেই আসে কাক্সিক্ষত এ বিজয়।
গত এক মাসেরও বেশি সময় আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। শুরুটা ৫ জুন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করার হাইকোর্টের রায়ের পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ও বিক্ষোভ নতুন করে ডালপালা মেলে। সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে এ রায় স্থগিত চেে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে চেম্বার আদালত। এর মধ্যে ৩০ জুনের মধ্যে দাবি পূরণ না হওয়ায় ১ জুলাই থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট সমন্বয়ক কমিটি গঠন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন টানা ৯ দিন আন্দোলনের পর গত ১০ জুলাই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কোটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেয়। তাতেও থামেননি শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর ১১ জুলাই ঢাকা, কুমিল্লাসহ কয়েক জায়গায় পুলিশের বাধা এবং সংঘর্ষের কারণে আরও বেশি ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষার্থীদের প্রতি ‘রাজাকার’ ধ্বনি! যেটি অভূতপূর্ব এবং হতাশাজনক ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সেদিন মধ্যরাতেই রাস্তায় নেমে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। স্লোগান দেন ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার/ আমি কে তুমি কে, রাজাকার-রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে সরকার, সরকার।’ আর এর সুযোগ নেয় ছাত্রলীগ। ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনায় ১৫ জুলাই ঝাঁপিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের চতুর্মুখী হামলার ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের মহানগর দক্ষিণ শাখা, বিভিন্ন হল, ঢাকা কলেজ শাখা এবং বহিরাগতদের পাঁচ ঘণ্টা ধরে চালানো তা-বে প্রায় ২৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হন। বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর বেশি হামলা করেন তারা। এরপরই মূলত ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরদিন এর প্রতিবাদে স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। ওইদিনই বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ১৭ জুলাইও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এতে পুলিশ, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হন অনেক শিক্ষার্থী। ঢাবিসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দেন ছাত্ররা।
সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নিহতের ঘটনা। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরপরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে সরে না এলে ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয় দমনপীড়ন, হত্যাকান্ড। ১৮-২২ জুলাই পাঁচ দিন সারা দেশে চলে তান্ডব। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন দল, সংগঠন ও জনতা। এই পাঁচ দিনে ১৫৭-এর বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সমন্বয়কদের গুম করার অভিযোগ ওঠে। কয়েকজন সমন্বয়ককে জিম্মি করে আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হয় বলে পরে এমন তথ্য উঠে আসে। সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২৮ জুলাই ১০ দিন পর সব ধরনের ইন্টারনেট সচল হয়। এর মধ্যে পুলিশ এবং ছাত্র-জনতার সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০০-তে।
২৩ জুলাই আপিল বিভাগ ৯৩ শতাংশ মেধা এবং ৭ শতাংশ কোটা রেখে রায় দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে বেশি নির্যাতন করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের। চারজন সমন্বয়ক ডিবির কাছে থাকলেও বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় আরও তিন সমন্বয়কে, একবার ফিরে এলেও আবারও হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া হয় তাদের। পরে ২৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ডিবি হেফাজতে থাকা আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। ডিবি কার্যালয় থেকে এক ভিডিও বার্তায় এ ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময় তার পাশে ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার এবং নুসরাত তাবাসসুম। তবে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন বাইরে থাকা সমন্বয়করা। তাদের ডাকে সারা দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান ছাত্র-জনতা। বেশ কয়েকজন মানুষ নিহত হন এ সময়, আহত হন হাজারো মানুষ।
সারা দেশে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ৩০ জুলাই রাত থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের ডিবি অফিসে আটক অবস্থায় অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। পরে সে খবর জানামাত্র সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমও অনশন শুরু করেন। অনশনের কথা পরিবার ও মিডিয়া থেকে গোপন করা হয়। প্রায় ৩২ ঘণ্টারও অধিক অনশনের পর ডিবিপ্রধান ছয় সমন্বয়ককে মুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলে অনশন ভাঙা হয়। পরবর্তী সময়ে ২ আগস্ট এক বিবৃতিতে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা স্বেচ্ছায় না দেওয়ার কথা এবং তাদের ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন ছয় সমন্বয়ক। একই সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
যেভাবে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় : আগস্টের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পূর্ণভাবে সংহতি জানাতে থাকে বিভিন্ন দল, সংগঠন, শিক্ষক, আইনজীবীসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। গত শুক্রবার গণমিছিলেই তার প্রমাণ মেলে। সেদিন শুধু শহীদ মিনারেই জড়ো হন অন্তত ১০ হাজার ছাত্র-জনতা। পরে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রায় এক লাখের মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তাতে সম্মতি জানায় সবপর্যায়ের মানুষ। এ সময় তারা বলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা দাবির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এক দফাটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এ সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ এবং শেখ হাসিনা ও এ সরকারের লুটপাট দুর্নীতি এবং গণহত্যার বিচার করা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে এক দফা দাবিতে আইনজীবী, শিক্ষকরাসহ মাঠে নামেন সবাই। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান পুলিশ সদস্যসহ ৯৭ জন। এর মধ্যেই সরকার পতনের চূড়ান্ত ডাক ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। আর তাতেই গতকাল সোমবারই সরকারপ্রধান পদত্যাগ করলে চূড়ান্ত বিজয় আসে ছাত্র-জনতার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলন কখনো বৃথা যায় না। তা আরও একবার প্রমাণ হয়েছে। এ সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে শুধু কোটা নয়, সব ধরনের বৈষম্যের সমাধান হবে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাব। আমাদের শুরু করা আন্দোলন সফলতার পেছনে শিক্ষক, আইনজীবীসহ সব পর্যায়ের মানুষের শ্রম, ত্যাগ রয়েছে। আমরা সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’
আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘খোলা রাজপথ থেকেই আন্দোলন হয়েছে, খোলা রাজপথ থেকেই আমাদের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে এবং খোলা রাজপথ থেকেই আমরা আমাদের চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণা করতে চাই। কোটা সংস্কার আন্দোলন আজ রাষ্ট্র সংস্কারে রূপ নিয়েছে আর তা চূড়ান্ত করেই আমরা ফিরব।’
ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। মুখ্য ভূমিকা রেখেছে ছাত্ররা। এখন প্রয়োজন সবার শান্ত-সংযত হওয়া। সবাই ধৈর্যশীল হন। অতীতে যেসব অপরাধ হয়েছে, প্রতিটি ঘটনার বিচার হবে।’
https://www.deshrupantor.com/526746