দেশ আজ গভীর ও মহা সংকটে পতিত। যে যাই বলুন, অভাবিত ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানের ফলে দেশ বর্তমান সরকারের জন্য কার্যত অশাসনযোগ্য (ungovernable) হয়ে গেছে। দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার কোন বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। তবে সংবিধানের ভিতর তিনটি উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন বর্তমান সরকার। শুধু মাত্র দরকার প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও শুভ বুদ্ধির উদয়।

১।জরুরীভিত্তিতে পার্লামেন্টে আইন পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (যে কোন নামেই ডাকা যেতে পারে) বিধান সংবিধানে নিয়ে এসে ঐ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, ঠিক যেভাবে বিএনপি করেছিল ১৯৯৬ সালে। বিএনপির জন্য তখন এটি করা সহজ সাধ্য ছিল না, কেননা সংবিধান পরিবর্তন করার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের ছিল না। ফলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে বিতর্কিত এক তরফা নির্বাচন করতে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের জন্য এটি করা অতি সহজ যেহেতু তিন-চতুর্থাংশ তো বটেই বরং সব এমপি তাদের দলেরই প্রায়! বিল এনে কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশ করিয়ে সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে।

২।তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায় আবার আপীল বিভাগ দ্বারা রিভিউ করিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায় সর্বসম্মত ছিল না। বরং এটি ছিল অনেকটা সমান সমানভাবে বিভক্ত রায়।

রায় প্রদানকারী ৭ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। আবার ৩ জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। বিচারপতি মো. ইমান আলীর রায়টি একটু ভিন্ন ধাঁচের হলেও তাঁর রায় স্পষ্টত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। একেবারে সমানভাবে বিভক্ত রায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোট তথা রায় বাতিলের পক্ষে চার-তিনে মেজরিটি হয়ে এই রায় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের সংখ্যাগরিস্ট বিচারপতিদের রায় হয়।
৪:৩-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেয়া হয়। ওই সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আপীল বিভাগ বলেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের উপর ভিত্তি করে পূর্নাঙ্গ রায় বের হবার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করত: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তৎকালীন মহাজোট সরকার। অথচ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে গুরুত্বপুর্ন মত সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেয়া হয় তা আমলেই নেয়নি সরকার।

আপীল বিভাগের রায়ের রিভিউ করার আবেদন কখনও করা হয়নি। তাই এ পথটি এখনও খোলা আছে। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় উদ্ভুত পরিস্তিতিতে যদি কয়েক দিনের ভিতর সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে শুনানী করে হাইকোর্টের রায়কে বাতিল করে রায় দিতে পারেন, জাতির প্রয়োজনে উদ্ভুত গণঅভ্যূত্থানের পরিস্তিতে জরুরীভিত্তিতে ২/১ দিনের মধ্যে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়ের রিভিউ করানো সম্ভব। শুধু দরকার সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা।

৩। সুপ্রিম কোর্ট ও পার্লামেন্টকে জড়িত (engaged) করে উপরের দুটি পথ ছাড়াও আরেকটি উপায়ে সাংবিধানিকভাবে সরকার ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। সংবিধানের ৫৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। ৭২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দেবেন। ৫৬(১) ও ৫৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যাতে একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয় সেই জন্যে প্রধানমন্ত্রী একজনকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন [৫৫(১)]। তাঁদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি [৫৬(২)]। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্যে সংসদ সদস্য হবার প্রয়োজন নেই, কেননা আমাদের সংবিধানে ৫৬(৩) অনুচ্ছেদে সুন্দর একটি প্রভিশন আছে এবং তাতে বলা আছে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সংসদ-সদস্যদের ‘অধিকাংশের আস্থাভাজন’ বলে রাষ্ট্রপতির কাছে ‘প্রতীয়মান’ হওয়াই যথেষ্ট। একজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া, প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আরেকজন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে দুই সদস্যের মন্ত্রীসভা গঠন এবং তারপরে প্রধানমন্ত্রীর রুলস অব বিজনেসের ক্ষমতাবলে ৭ বা তার বেশি বেজোড় সংখ্যক উপদেষ্টা নিয়োগ। এই ব্যক্তিদের বাছাই করবে আন্দোলনকারীরা, রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র নিয়োগ দেবেন, এই ব্যক্তিদের বাছাইয়ের তাঁর কোনও ধরণের ভূমিকা থাকবেনা। এই নয় জন ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন বা জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার (তিনটি নামের যে কোন নামে ডাকা যায়) হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত (emerged) শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ এখন পর্যন্ত সংবিধানের ভেতরেই আছে। এর বাহিরে যে ব্যবস্থা সেটা হচ্ছে অসাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ – হয় তা হবে ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগে বা আমন্ত্রণে, অন্যথায় রাজপথের শক্তির জোরে। এমন পরিস্তিতিতে ১/১১ এর মতো কোনো এক শক্তি এসে ক্ষমতা নিবে যার বৈধতা পরবর্তী সরকারকে দিতে হবে।

ক্ষমতা হস্তান্তরে সংবিধানের ভেতরে উপরের তিনটি পথ ছাড়া আর কোন উপায় দেখা যাচ্ছে না। সরকার প্রধানকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময় ফুরিয়ে গেলে অসাংবিধানিক উপায়েই হয়তো সমাধান হতে হবে যা (ইতিহাস বলে) সরকার প্রধান বা তার স্বীয় দলের জন্য মোটেই সুখকর হবে না। তাই দেরি হওয়ার আগে বুঝুন ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিন। নতুবা দারুণভাবে পস্তাতে হবে এবং আফসোস করতে হবে, যেমনভাবে পস্তাতে হয়েছে ও আফসোস করতে হয়েছে রাজনীতিবিদদের একাধিকবার বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে। রাজনৈতিক ভুল অনেক সময় জীবন দিয়েও শোধরানো যায় না।

নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।