শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী চলমান আন্দোলনে একদফা দাবির সমর্থনে সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতিসহ চার দফা রূপরেখা দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। প্রস্তাব অনুসারে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে সংবিধানের ৫৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

রোববার (০৪ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম এ রূপরেখা তুলে ধরেন।

প্রস্তাবনায় সরকারপ্রধান কীভাবে, কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন তা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে সংবিধানের ৫৭ (১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৫৭ (১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকারী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।

রূপরেখার প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপতির কাজ সম্পর্কেও বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। দায়িত্ব গ্রহণের সাত দিনের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে আটককৃত সব শিক্ষার্থী, নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মুক্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। দায়িত্ব গ্রহণের ১০ দিনের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনরত সব শক্তির সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে সর্বজনগ্রহণযোগ্য কিছু ব্যক্তির নামের তালিকা প্রস্তুত করবেন, যাদের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে একজনকে দায়িত্ব প্রদান করা হবে। সংক্ষিপ্ত তালিকার মধ্য থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা একজনকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত করবেন এবং তাকেই রাষ্ট্রপতি ওই দায়িত্বে নিয়োগ দেবেন।

প্রস্তাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কেও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাসহ আন্দোলনকারী সব দল ও সংগঠনের সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে ১০ থেকে ১৫ জনকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানসহ কোনো উপদেষ্টা পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে প্রাণহানির ঘটনায় পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও নির্দেশ পালনকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা এবং ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সড়ক ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিসমূহ বাস্তবায়ন করবেন। চলমান আন্দোলনে জনগণের মধ্যে দানা বাধা ‘রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট বিভাগ/প্রতিষ্ঠান/আইন-কানুন/সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাস্কফোর্স গঠন এবং গণআলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। টাস্কফোর্স দ্বারা প্রস্তাবিত এবং গণআলোচনার মাধ্যমে উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহের সমন্বয়ে ‘সংবিধান সংস্কারের ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি করবেন। পরে নির্বাচিত সরকার যাতে সেই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকে তার ব্যবস্থা করবেন। সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি করবেন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় সংস্কার করবেন। সংবিধান সংস্কার ও সরকার গঠনের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবেন এবং নির্বাচন শেষে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

প্রস্তাবনায় নির্বাচিত সরকারের প্রথম দিকের কিছু কাজও তুলে ধরা হয়। প্রস্তাব অনুসারে, নির্বাচিত সরকারের প্রথম কাজ হবে গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার করা সংবিধান চূড়ান্তভাবে পাস করা। দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত ‘সংস্কার ফ্রেমওয়ার্ক’ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন। গণভোটে পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারের রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। গণভোটে সংস্কারকৃত সংবিধান পাসের পর সেই সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।

হাসনাত কাইয়ূম বলেন, সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বহুমুখী আক্রমণের মুখেও শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষও আজ তাদের সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি গণঅভ্যুত্থানের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। শহীদ আবু সাঈদসহ শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন আজ পুরো বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই সংস্কার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অতীতে ছাত্রদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল সব সময় বেহাত হয়ে গিয়েছিল। এইবার আমরা তা অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করব। শত শত শহীদের রক্তের দায় আমাদের মেটাতেই হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আর বক্তব্য রাখেন দলের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া, জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য হাবিবুর রহমান রিজু প্রমুখ। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের রাজনৈতিক সমন্বয়ক ফরিদুল হক, মিডিয়া ও প্রচার সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দিন হোসেন, সাংগঠনিক সমন্বয়ক ইমরান ইমন, জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবদুল জলিল, ঢাকা জেলা সমন্বয়ক শাহাবুদ্দিন কবিরাজ লিটন, রাষ্ট্র সংস্কার যুব আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক মাশকুর রাতুল, রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আহমেদ ইসহাক, রাষ্ট্র সংস্কার শ্রমিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম হোসেন প্রমুখ নেতারা।