রাজধানীর কাছেই সাভারের শিল্পাঞ্চল খ্যাত আশুলিয়ায় গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে গ্যাস সিলিন্ডার রিফিলের অর্ধশতাধিক কারখানা। কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই আবাসিক এলাকার খালি জায়গা বা ঘর ভাড়া নিয়ে তৈরি এই কারখানাগুলোকে মৃত্যুর গোডাউন বলছেন স্থানীয়রা। বড় সিলিন্ডার ভেঙে গ্যাস কম দেওয়ার জন্য বালি ও পানি মিশিয়ে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের’ ছোট ছোট সিলিন্ডারে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভরতে গিয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা এবং মানুষের প্রাণ গেলেও প্রশাসন ও পুলিশ বলছে, এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।

সবশেষ ১৩ মে ফ্যান্টাসি কিংডমের পাশে তেঁতুলতলা এলাকায় গ্যাস ভরার সময় বিকট বিস্ফোরণে নয় বছরের শিশুসহ পাঁচ শ্রমিক গুরুতর দগ্ধ হয়; তাদের মধ্যে চারজনই রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে ৪ মে আশুলিয়ার কাঠগড়ায় রাতের আঁধারে এমন আরেকটি কারখানায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণের গোটা এলাকা কেঁপে উঠে। সেখানে কেউ আহত না হলেও আশপাশের বাড়িঘর, বিদ্যুৎ লাইন, পানির ট্যাংক দোকান ও গাছ পুড়ে যায়। খসে পড়ে বিভিন্ন বাড়ির ছাদের ও দেয়ালের পলেস্তারা। এছাড়া এসব কারখানায় ছোটখাট অনেক দুর্ঘটনা ঘটলে মালিকপক্ষ তা ধামাচাপা দেয় কিংবা ‘ম্যানেজ’ করে ফেলে বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৩ মে এবং ৪ মে দুটি বিস্ফোরণের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদরপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহা. নায়েব আলী প্রতিবেদককে বলেন, “বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে ঘটনার পর পরিদর্শন করা হয়েছে। আমাদের অফিসার একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছেন।” প্রতিবেদনে কী রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি বাইরে আছি। তাই সঠিকভাবে বলতে পারছি না।”

স্থানীয়দের অভিযোগ, মেয়াদবিহীন এবং নিম্নমানের সিলিন্ডারগুলো যেন এক একটা ‘বোমা’। বিভিন্ন সময় তারা এ নিয়ে প্রশাসনকে জানিয়েছেন। কিন্তু কোথাও বিস্ফোরণ হলেই প্রশাসনের লোকজন এসে খবর নেয়। কিন্তু জড়িতরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আর ব্যবসাও চলছে নির্বিঘ্নে।

গত কয়েকদিনে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের কারখানার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি বিরাট চক্র এই অবৈধ ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা খোলাবাজারের এজেন্টদের কাছ থেকে বিভিন্ন নামী-দামী কোম্পানির ৪৫ লিটার, ৬০ লিটার, ৬৪ লিটারের বড় বড় সিলিন্ডার কিনে নেয়। তারপর সেগুলো ভেঙে ছোট ছোট সিলিন্ডারে ভরা হয়। আবাসিক এলাকায় খোলা জায়গা ভাড়া নিয়ে টিনের শেড তৈরি করে এসব কারখানা করা হয়। অনেক সময় পরিত্যক্ত গুদাম ঘরও এসব কাজে ব্যবহার করা হয়। এলাকাবাসী এ ধরনের কারখানার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েও কোনো ফল পায়নি। ফলে এ ধরনের কারখানার পাশে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের বসবাস করতে হচ্ছে।

এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে কোনো মাপের সিলিন্ডারে প্রতিটি কোম্পানির নাম এবং রিফিলের তারিখ থাকা বাধ্যতামূলক থাকলেও এখানকার ছোট ছোট সিলিন্ডারে কোনো কোম্পানির নাম থাকে না, রিফিলের তারিখও থাকে না। সাধারণত এগুলো লাল রং করা থাকে। আর মেয়াদহীন ও নিম্নমানের এসব সিলিন্ডার স্থানীয়ভাবেই সংগ্রহ করা হয়। ক্রেতারা সচেতন না হওয়ায় সেই সিলিন্ডার কিনে নিয়ে বাসাবাড়িতে রাখেন, যা থেকে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে থাকে।

 

 

যেভাবে ভরা হয় গ্যাস

সম্প্রতি আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকার একটি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ফটকে তালা ঝুলছে। কিন্তু গেইটের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে একজন গ্যাস রিফিল করছেন। বার বার ডাকলেও কেউ গেইট খুলতে রাজি হননি। কথা বলতে চাইলেও সেই শ্রমিক কথা বলতে রাজি হননি। পরে অন্য একটি কারাখানায় ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ঘরজুড়ে ছোট-বড় সিলিন্ডারের মজুদ। একপাশে উল্টো করে রাখা হয়েছে বড় সিলিন্ডার। তার ওপর রয়েছে বরফের টুকরা। পাশেই একটি প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর রাখা রয়েছে ১২ কেজির সিলিন্ডার। ড্রামটিও বরফে পরিপূর্ণ।

 

এ ধরনের কারখানায় আকারভেদে সাধারণত চার থেকে ছয়জন শ্রমিক কাজ করেন। যখন গ্যাস রিফিলের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করা হয়, তখন অন্যরা ঘর থেকে সরে যায়। ঘরে দক্ষ একজনই থাকেন এবং তিনিই সেটি করেন। ১২ কেজির ছোট সিলিন্ডারের নজলটি প্রথমে একটি বিশেষ যন্ত্র দিয়ে খোলে ফেলা হয়। তারপর সিলিন্ডারটিতে ভরা হয় কয়েক কেজি বালু ও পানি। এরপর সিলিন্ডারটি একটি বড় কাটা ড্রামের মধ্যে বসানো হয়। আর চারপাশে দেওয়া হয় বরফ; যেন গ্যাসের তাপে সেটি শীতল থাকে। এরপরই করা হয় মূল কাজটি। বড় সিলিন্ডার থেকে পাইপ দিয়ে গ্যাস ছোট সিলিন্ডারে স্থানান্তর করা হয়। সিলিন্ডারটি ভরার সময় বরফ ও বাতাস মিলে ঘন বাষ্পের মত বের হতে থাকে।

 

কাঠগড়ার এই কারখানাটিতে কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও জানা যায় এর মালিক কালাম মিয়া। তিনি মোবাইল ফোনে প্রতিবেদককে বলেন, “নূর নবীর মাধ্যমে গ্যাস রিফিলের ব্যবসা শুরু করি। আমিসহ এমন কয়েকজনের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন নূর নবী।” তিনি আরও বলেন, “পুলিশসহ বিভিন্ন জায়গায় ম্যানেজ করতে মাসে এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা নূর নবীর হাতে তুলে দিই। তিনিই সব দেখাশোনা করেন। নূর নবী ছাড়াও এখানে লালন, বেলাল, করিম, নাহিদ, খোকন, বাদল, হেলালসহ অনেকেই রিফিলের কাজ করেন।”

 

এলপি গ্যাস সরবরাহকারী বড় কোম্পানিগুলোর ডিলারদের কাছেও এসব অজানা নয় দাবি করে তিনি বলেন, “তারা বিক্রি বাড়িয়ে টার্গেট পূরণ করার জন্য সবসময় চুপ থাকেন।” সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে চক্রের ‘মূল হোতা’ হিসেবে কাঠগড়ার লালন ও তাজপুরের নূর নবীর নাম উঠে আসে। আশুলিয়ার এলপি গ্যাসের ডিলার নজরুল ইসলাম বলেন, “চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে কৌশলে খালি সিলিন্ডার কিনে নেয়। “এরপর ৪৫ কেজির একটি বড় সিলিন্ডারের গ্যাস দিয়ে ১২ কেজির পাঁচটি সিলিন্ডার ভরা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি সিলিন্ডারে তিন কেজি করে গ্যাস কম দেওয়া হয়। অনেকক্ষেত্রে ১২ কেজির এসব সিলিন্ডার পরিচিত কোম্পানির হওয়ায় সাধারণ গ্রাহক সন্দেহও করে না।” এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামগড়া এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দারা বলেন, “আবাসিক এলাকার মধ্যে বাসা ভাড়া নিয়ে গ্যস সিলিন্ডার মজুদ করে রাতের আঁধারে রিফিল করে। আমরা এলাকার বাসিন্দারা সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে নীরব।” এলাকার অনেকেই জানান, সেদিন বিস্ফোরণে অনেকেরই ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি কারাখানার মালিক তিনি উধাও। তার আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বিস্ফোরণের পর পুলিশ আর সরকারি দপ্তরের লোকজন এসেছিল; কিন্তু তারপর আর কোনো খবর নেই। এলপি গ্যাসের ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত মেয়াদহীন বা নিম্নমানের সিলিন্ডার আর বিপজ্জনকভাবে গ্যাস স্থানান্তর করার সময়ই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকে।

বিস্ফোরক পরিদপ্তর সূত্র জানায়, বড় বড় কোম্পানির সিলিন্ডার ভাল মানের ইস্পাত দিয়ে তৈরি। এগুলোর ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। ল্যাবে পরীক্ষা করে মান উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রতিটি সিলিন্ডার প্রথমে ১০ বছরের জন্য বাজারে ছাড়া হয়। আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর পর পর সেগুলো পরীক্ষা করতে হয়। সিলিন্ডারের মেয়াদ এর গায়েই ‘সাংকেতিকভাবে’ খোদাই করে লেখা থাকে। তবে আশুলিয়ার কারখানা ঘুরে যেসব ছোট বড় সিলিন্ডার দেখা গেছে, এর কোনোটার গায়েই কোনো কোম্পানি নাম কিংবা মেয়াদের তারিখ লেখা নেই।

 

বাংলাদেশে যে কয়টি কোম্পানি এলপি গ্যাস সরবরাহ করে থাকে তার মধ্যে বৈশ্বিক ‘টোটাল গ্যাস’ অন্যতম। কোম্পানিটির এক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, “কোনো সিলিন্ডারের যদি মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তাহলে নিয়ম হচ্ছে কোম্পানি নিজেই সেটি ধ্বংস করে দেবে এবং স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রি করবে। কিন্তু কী পরিমাণ সিলিন্ডার এভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে সে ব্যাপারে বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে অবহিত করতে হয়।” ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিইপিজেড স্টেশনের ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক ওয়ালি উল্লাহ বলেন, “এসব সিলিন্ডারের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। মেয়াদ শেষে এসব সিলিন্ডার ধ্বংস করে দেওয়ার কথা। কিন্তু কিছু অসাধু সেগুলো ধ্বংস না করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে দেয়। ভাঙারির দোকান থেকে এসব সিলিন্ডার কিনে নিয়ে গ্যাস রিফিলের কাজে লাগানো হয় বলে ধারণা করি।” একই কথা জানালেন আশুলিয়ার এলপি গ্যাসের ডিলার নজরুল ইসলামও। তিনি বলেন, “কোনো জিনিস তো আজীবন চলবে না। মেয়াদ শেষে ধ্বংস করাই নিয়ম। কিন্তু ধ্বংস না করে অনেকেই বিক্রি করে দেন।

 

নীরব পুলিশ ও প্রশাসন

স্থানীয়রা বারবার অবৈধ কারখানা ও গুদামের কথা বললেও এসব সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, “এ ধরনের অবৈধ রিফিলের কথা জানা নেই। স্থানীয় পুলিশ যদি তথ্য পায় এবং আমাদের জানায় তাহলে আমরা অভিযান পরিচালনা করতে পারি।”

তবে প্রশাসনের নিজেদের উদ্যোগে এসব অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান না চালানোর আভাস পাওয়া গেছে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও। কারও কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই শুধু অভিযান চালানো হয়। বিস্ফোরণের ঘটনার পর বিস্ফোরক পরিদরপ্তরের পক্ষ থেকে মামলা করা হয় কি-না জানতে চাইলে উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মনিরা ইয়াসমিন প্রতিবেদককে বলেন, “সাধারণত ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকেই মামলা করা হয়। তবে অনেক সময় পরিদপ্তরের পক্ষ থেকেও করা হয়।”

এ ধরনের অবৈধ গ্যাস রিফিল প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সারাদেশে এই পরিদপ্তরের জনবলের পদ রয়েছে ১০৪টি। তবে সব পদে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেই। সুতরাং এত কম জনবল নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর।” তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয় বলে তিনি জানান। অন্যদিকে পুলিশও বলছে, এ ধরনের কারখানার কথা তাদের জানা নেই। আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোমিনুল হক বলেন, “এখন পর্যন্ত এসব কারখানার বিষয়ে জানিয়ে কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।”

তবে জিরাবো মডার্ন ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আহমেদুল কবির জানিয়েছেন, “আশুলিয়ায় গ্যাস রিফিলের এমন অসংখ্য কারখানা রয়েছে। যার কোনোটারই অনুমোদন নেই। অর্থাৎ অবৈধভাবেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কারখানাগুলো।” ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড) ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর ওয়ালিউল্লাহ বলেন, “মূলত এসব কারখানায় পুরনো বোতলে গ্যাস ভরে বিক্রি করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি এবং পুরোনো বোতলের কারণে এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।”

 

ই.এক্স/ও.আর/বার্তা বাজার