দিন যতো গড়াচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংকট ততোই গভীর হচ্ছে। দ্বীর্ঘ সাত বছর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে আসা প্রায় দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখছেনা। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে স্বশস্ত্র বিদ্রোহীদের সাথে দেশটির সেনাবাহিনীর চলমান যুদ্ধে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃংখলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানিয়েছে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি।

সীমারক্ষী বাহিনী বিজিবি ও কোস্টগার্ড অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এমনটি দাবী করলেও দালালদের সহায়তায় অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের ৩১ জন দালালের সহযোগীতায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে।

রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি রয়েছে বলে দাবী করে বলেন, নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তারা স্থানীয় আত্মীয় স্বজনদের বাসা বাড়ি ও গোপনে মোটা অংকের বিনিময়ে বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান করছে। আবার কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়ছে বলে জানাগেছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের আটকে কোন অভিযান চোখে পড়ে নাই। তাই আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান তিনি।

‘বার্তা বাজার’র সাথে কয়েকজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী সাথে কথা হলে তারা জানায়, প্রথমে মিয়ানমারের দালালদের সাথে তারা চুক্তি করে। চুক্তি হয়ে গেলে রোহিঙ্গাদের টেকনাফে অবস্থানরত দালালদের মোবাইল নাম্বার দেয়। নাম্বারটি নিয়ে তারা বিদেশে অবস্থানরর পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। পরে বিদেশ থেকে টেকনাফে অবস্থানরত দালালদের সাথে যোগাযোগ করে দিন ক্ষন ও অর্থ লেনদেনের বিষয়টি ঠিক করে। টেকনাফ কেন্দ্রিক দালালদের ফোন পেলেই রাতের অধারে সুযোগ বুঝে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা অনুপ্রবেশ করে।

মাঝে মধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও তাদের পুশ ব্যাক করা হয়। সুযোগ বুঝে তারা ফের অন্য ঘাট দিয়ে অনুপ্রবেশ করে বলেও জানা গেছে।

অনুসন্ধান বলছে, মাথাপিছু ৩০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত চুক্তি হয়। টেকনাফ সীমান্ত কেন্দ্রিক এরকম অন্তত ৩১ জন দালালের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্য রয়েছে- কোস্টগার্ডের সোর্স খ্যাত মিজান, শামসু আলম উরুফে সাম্বাদিক শমশু, মোয়াজ্জেম হোসেন দানু (সাবেক মেম্বার), আব্দুল আমিন মাঝি, নবী হোসেন, ফজল আহমদ, ইব্রাহীম, ইসমাইল, সাদেক, বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, সালমান, শামসুল আলম, জাবেদ, ইমান হোসেন ইউছুপ, ইউনুছ, সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, জিয়াবুল, শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমদ, শফিক, ফারুক, জয়নাল, নুর হোসেন ও সাদ্দাম। এরা প্রত্যেকেই টেকনাফের বাসিন্দা। এ ছাড়া আরও কিছু ব্যক্তি রোহিঙ্গা পাচারে জড়িত। পুলিশের তালিকায় এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে মানব পাচার মামলাও রয়েছে।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি তদন্ত আব্দুল্লাহ আল মানুন জানান, কিছু কিছু জায়গা দিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি শুনেছি। এই ঘটনায় সম্পৃক্ত দালালদের সনাক্ত করতে পুলিশের গোয়েন্দা টিম মাঠে কাজ করছে। এমন অপকর্মে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

দালালদের হাত ধরে সীমান্তে অন্তত ২১টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। পয়েন্টগুলো হলো- টেকনাফ সীমান্তের দমদমিয়া, জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং পাড়া, হ্নীলা চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ, মেরিন ড্রাইভের খুরের মুখ, মুন্ডার ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, তুলাতুলি, হাবির ছড়া, জালিয়াপাড়া গোলারচর, শাপলাপুর ও বান্দারবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু, ঘুমধুম।

সীমান্তে রোহিঙ্গা পাচারে দালাল চক্র গড়ে উঠেছে বলে স্বীকার করে নৌ-পুলিশের টেকনাফ স্টেশন ইনচার্জ তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতে সুযোগে কিছু দালাল চক্রের রোহিঙ্গা পারাপারের বাণিজ্য গড়ে তোলার খবর আমরা শুনেছি। বিভিন্ন সময় অনুপ্রবেশের সংবাদ এলেও জনবল ও নৌযান না থাকায় আমরা তৎক্ষণাৎ অভিযানে নামতে পারি না।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার অফিসার ইনচার্জদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তে দালল দমনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো পাশাপাশি পুলিশ জিরো টলারেন্স ভূমিকায় রয়েছে।