দেড়শ বছরের পুরোনো ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় এখনো গড়ে উঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বর্জ্য পরিশোধনে পরিকল্পিত কোন ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্যের ভাড়ে ধুঁকতে হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর এই পৌরসভাকে। ফলে ডাম্পিংয়ের নামে প্রতিদিন দেড়শ টন বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে অথবা সড়কের পাশে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
সচেতন মহলের মতে, পরিকল্পিত উপায়ে বর্জ্যপরিশোধনের ব্যবস্থা না থাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় প্রায় তিন লক্ষ মানুষের বসবাস। দিন যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে বসবাসকারীর সংখ্যা। পৌর এলাকায় জনগোষ্ঠীর বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বর্জ্যের পরিমাণও। প্রতিদিন উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পরিশোধন করতে না পেরে এগুলো রাখতে হচ্ছে বিভিন্ন সড়কের পাশে। অথবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে বিভিন্ন এলাকার অলিতে গলিতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রতিদিন অন্তত দেড়শ’ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার মধ্যে বিভিন্ন বাসা বাড়িসহ হাসপাতাল-ক্লিনিক ও হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য রয়েছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২০১২ সালে শহরের ছয়বাড়িয়া এলাকায় ৩ একর জায়গায় ডাম্পিং স্টেশন করে পৌরসভা। যদিও সেখানে নেই বর্জ্য পরিশোধনে পরিবেশবান্ধব কোন প্রযুক্তি।
২০২৩ সালে বর্জ্য থেকে সার ও জ্বালানি তেল উৎপাদনে একটি পাস্ট স্থাপন করা হলেও কোন সংস্থা এগিয়ে না আসায় তাও উৎপাদনে আসেনি। এতে ডাম্পিংয়ে থাকা বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিন আহরিত বিপুল পরিমাণ বর্জ্য স্তূপ হয়ে পাহাড় টিলায় পরিণত হয়েছে। বর্জ্যে উৎকট দুর্গন্ধে ছড়িয়ে পৌরবাসীর দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা। নোংরা পরিবেশ হওয়ায় মশা-মাছিসহ নানা রকমের বিযাক্ত ও ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের অবাধ বংশবিস্তার চলছে।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, লোকালয়ের খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বর্জ্যের ভাগাড়। বর্জ্যের স্তূপ ডাম্পিংয় স্টেশনে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ফেলে রাখা হয়েছে ব্যস্ত সড়কের পাশে। গোকর্ণ-পৈরতলা সড়ক দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের চলাচল। তবে এই পথে চলাচল করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা। কেউ নাক ঢেকে, আবার কেউ মুখে হাত চেয়ে কোন মতে পারাপার করছেন।
আবাসিক এলাকা হওয়ায় আশেপাশে রয়েছে বহু মানুষের বসবাস। ছয়বাড়িয়া এলাকা ছাড়াও শহরের জনবহুল ও মিনি পার্ক খ্যাত টেংকের পাড় এলাকার মূল ফটকের সামনে মডেল ডাস্টবিনের নামে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বর্জ্য এনে স্তূপ করে রাখা হয়। বাণিজ্যেক এই এলাকার উপর দিয়ে দিয়ে অন্তত ১০/১২ টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলাচল।
চারদিকে রয়েছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও কমিউনিটি সেন্টার। প্রতিদিন সড়ক দখল করে এই পয়েন্টে চলে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ। এতে বর্জ্যের পচনসহ দুর্গন্ধে সাধারণ মানুষের অবস্থা নাকাল। বৃষ্টি হলে এসব বর্জ্য রাস্তার উপড়ে চলে আসায় নানা রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ পৌর কর্তৃপক্ষকে বার বার অবহিত করার পরও কোনো সুরাহা মিলছে না।
পৌরবাসীরা জানান, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে হয়াবড়িয়া, টেংকের পাড়সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে দিন পাড় করছে। অনেকটা তারা বাধ্য হয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। বর্জ্যের স্তূপ বাসা-বাড়ির আঙ্গিনায় পর্যন্ত এসে পড়েছে। ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ করে রাখতে হয়।
ছয়বাড়িয়ায় ডাম্পিং স্টেশন করা হলেও কোন রকম সীমানা প্রাচীর বা পরিবেশবান্ধব বেষ্টনী দেয়া হয়নি। এতে দুর্গন্ধ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি মশা-মাছির কারণে ঠিকভাবে খাওয়া- দাওয়া পর্যন্ত করা যায় না। এমন কষ্টের কারণে অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র ঘর ভাড়া করে থাকছেন। এছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্টে ভুগছে সাধারণ মানুষ। দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে দেখা দিতে পারে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়।
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আবদুন নূর বলেন, পুরো পৌরসভাই এখন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় হয় বাড়িয়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্তূপ হয়ে থাকে। এতে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। আমি পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাই যাতে দ্রুত এই সমস্যা সমাধান করে শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করা হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল কুদ্দুস বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, পৌরসভার দীর্ঘ যাত্রায় আমরা আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি। তবে সম্প্রতি আমরা কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। যাতে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বিসল চক্রবর্তী বলেন, বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য পৌরসভাকে অবহিত করা হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।