চলতি বছর বর্ষার শুরুতে ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে গোমতীতে থইথই করছে পানি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একসময়কার খরস্রোতা গোমতী নদীকে খাঁখাঁ বালুচরে পরিণত হতে দেখা গেছে। ভরা বর্ষায়ও কাঙ্ক্ষিত পানির দেখা পাওয়া যায়নি। কিন্তু চলতি বছর বর্ষার শুরুতে ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী নদীটি। বর্তমানে গোমতীতে থইথই করছে পানি। এতে অবতারণা হয়েছে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের। আবার নদীর পাড় ভেঙ্গে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ার আতঙ্কও রয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদীগুলোর একটি হলো গোমতী নদী। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের ডুমুর নামক স্থানে উৎপত্তি হয়ে এঁকেবেঁকে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটকবাজার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত-বাংলাদেশের অন্যান্য যৌথ নদীর মতো গোমতীতেও বছরের অধিকাংশ সময় পানির দেখা পাওয়া যায় না। স্থানে স্থানে বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে চর। এসব চরে সবজিসহ নানা ফসলের আবাদ হয় বারো মাস। এ বছর আকস্মিক ভারী বর্ষণে মৌসুমি ফসলের কিছুটা ক্ষতি হলেও গোমতীর বুকে থইথই পানি দেখে খুশি গোমতীপারের মানুষ।
কুমিল্লার গোমতী নদীতীরবর্তী মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ বাজার, ধামঘর, ত্রিশ, ভূবনঘর, দড়িকান্দি ও দেবীদ্বার উপজেলার বিনাইটাড়, শিবনগর, বড় আলমপুর ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে থইথই করছে।
মুরাদনগর বাজারের ব্যবসায়ী রিপন সরকার বলেন, ‘আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনেছি, এই নদীকে কেন্দ্র করে ৩০০ বছরে আগে মুরাদনগর বাজার গড়ে ওঠে। গোমতী নদীতে পানি না থাকায় একসময়ের নামডাকওয়ালা বাজারও এখন যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বহু বছর পর নদীতে পানি দেখে পুরোনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এইতো সেদিন বড় বড় নৌকা ভিড়ত বাজারে।’
ধামঘর গ্রামের গোমতীপারের বসতি মুরাদনগর উপজেলার সাবেক তিনবারের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সানোয়ারা বেগম লুনা স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘একসময় এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান পথ ছিল গোমতী নদী। নদীতে ছোট-বড় অনেক নৌকা চলত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই বাজারে আসত পণ্য কেনাবেচার জন্য। এখানে ছিল একসময়ের অর্থকরী ফসল পাটের বৃহত্তম বাজার। সেই সঙ্গে চাল, আলু ও মাছের বিশাল বাজার বসত। এখন সেই ভরা নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এ বছর নদীতে আবার পানি এসেছে দেখে অনেক ভালো লাগছে।’
জানা গেছে, ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর-সোনাইমুড়ী থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীটি কুমিল্লা সদর, বুড়িচং, দেবীদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি হয়ে মিলিত হয়েছে মেঘনা নদীর সঙ্গে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৬৫ মিটার। একসময়ের তীব্র খরস্রোতা গোমতীতে দীর্ঘদিন পানি না থাকায় নাব্যতা হারাতে থাকে। ‘খরস্রোতা’ পরিচয় মুছে এটি রূপ নিতে থাকে ‘রোগা খালে’। আর মানুষ হেঁটেই চলে যেত একসময়ের উন্মত্ত যৌবনা গোমতীর এপার থেকে ওপারে।
কিন্তু এবার গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকেই পাল্টে যেতে থাকে সেই চিত্র। কয়েক সপ্তাহের মাঝারি ও ভারী বর্ষণের সঙ্গে পাহাড়ি বানে যৌবন ফিরিয়ে দিতে থাকে তার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পানি, সঞ্চার হতে থাকে প্রাণ। রোগা ভাব কাটিয়ে সে এখন পূর্ণ যৌবনা। খরস্রোতা না হলেও প্রবহমান।
গোমতীর সুদর্শন বেড়ীবাঁধ ও নদীর পাড়ঘেঁষা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কিছু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ছোট ছোট বিনোদনকেন্দ্র। এগুলো ঘিরে শেষ বিকেলে জমে দর্শনার্থীদের ভিড়। নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই বিভিন্ন বয়সী নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের ভিড় বাড়ে নদীর পারে।