রাজশাহীর বাঘা পৌরসভার মেয়র ও বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ আলীর বিরুদ্ধে দলের মধ্যেই অভিযোগের অন্ত নেই। এবার উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম বাবুল হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে নতুন করে সমালোচনার ঝড় উঠেছে তাকে নিয়ে। অতীতের নানা বিতর্কিত ঘটনাও ফিরে আসছে এ আলোচনাতে।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে কালো পতাকা দেখানো থেকে শুরু করে পৌরসভায় বসে মদপান, পুলিশকে হুমকি ও ধর্ষণচেষ্টাসহ অনেকগুলো মামলা ও জিডি রয়েছে মেয়র আক্কাছের নামে। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে আক্কাস আলীকে ‘সন্ত্রাসীদের গডফাদার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। মাদকাসক্তি যাতে কাটিয়ে উঠতে পারেন, সেজন্য তাকে একসময় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছে।

থানায় রয়েছে ২২ মামলা ও ১৭ সাধারণ ডায়েরি

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আক্কাছ আলীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, টেন্ডারবাজি ও মাদক সেবন করে মাতলামিসহ বিভিন্ন অভিযোগে থানায় ২২টি মামলা এবং ১৭টি সাধারণ ডায়েরি রয়েছে। তবে জানা গেছে, বাদীর ওপর চাপ প্রয়োগ করে ও প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ মামলাতেই তিনি আপসরফা করে নিয়েছেন। এলাকায় নিরাপদে বসবাসের স্বার্থে অনেক বাদীই সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন।

পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আক্কাছ আলী স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষণাবেক্ষণে ও প্রশাসনিক কাজে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করেন। বাঘা উপজেলায় জননিরাপত্তাহানি ও জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের পেছনে তিনি বিভিন্ন সময় সরাসরি মদদ জুগিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের এক কর্মীর বোন ও স্ত্রীকে নির্যাতন ও শ্লীলতাহানি মামলার প্রধান আসামি ছিলেন তিনি। ঘটনাটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসার পর এ ব্যাপারে তদন্ত হয়। অনুসন্ধানে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হওয়ায় আক্কাছ আলী তখন দলীয় পদ হারান এবং দীর্ঘ সময় কারাবাসও করেন।

আলোচিত যত অভিযোগ
২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল বাঘা থানা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক সোহেল আহাম্মেদকে গালিগালাজ ও হুমকি দেওয়ায় আক্কাছ আলীর নামে থানায় লিখিত অভিযোগ বা জিডি করেন ওই এসআই। ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা জজ আদালতের নাজিরসহ আদালতের ৬ কর্মচারীকে পিটিয়ে তিনি আবারও আলোচনায় আসেন। এর আগে মদপান করে বাঘা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজয় মঞ্চে পুরস্কার বিতরণের সময় তিনি এক শিক্ষার্থীর গায়ের ওপর ঢলে পড়েন। বাঘা পৌর ভবনে বসে মদপান করে মাতলামি করায় পৌরসভার তিনজন নারী কাউন্সিলরসহ ৯ জন কাউন্সিলর থানায় আক্কাছের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এছাড়া উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের এক গৃহবধূকে মাতাল অবস্থায় ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে ওই গৃহবধূর মা থানায় তার নামে মামলা করেন।

সাম্প্রতিক সন্ত্রাস-হামলা ও বাবুলের মৃত্যু
আক্কাছ আলী ২০২২ সালের ২১ মার্চ কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সন্ত্রাসীদের নিয়ে হামলা চালালে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। গত ২২ জুন বাঘা উপজেলা পরিষদ চত্বরের সামনে সকাল ১০টায় তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের ব্যানারে মানববন্ধন হয়। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা চালান আক্কাছ আলীসহ তার ক্যাডার বাহিনী। এ সময় আহত হন বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলসহ অন্তত ৫০ জন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৬ জুন বিকালে মৃত্যু ঘটে তার। এ মামলার প্রধান আসামি আক্কাছ আলী। তবে পুলিশের ভাষ্য, পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এর আগেও একবার বাবুলের ওপর হামলা চালায় এবং কুপিয়ে পঙ্গু করে।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াহেদ সাদিক কবির, আড়ানী পৌর মেয়র মুক্তার আলী ও যুবলীগ নেতা শাহিনুর রহমান পিন্টুসহ দলীয় অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ, এর আগেও দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী একাধিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত মেয়র আক্কাসের নেপথ্যে থেকে মদদ জোগাচ্ছেন রাজশাহীর একজন সংসদ সদস্য, একজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ কয়েকজন স্থানীয় নেতা। যাদের নাম বাবুলের জানাজায় এক স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তুলে ধরেছেন।

বাঘা থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আমিনুল ইসলাম জানান, পৌর মেয়র আক্কাছ আলীর নামে বিভিন্ন সময় থানায় দায়ের করা একাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে। গত ২২ জুন তার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের ব্যানারে মানববন্ধন হয়। তিনি ও তার লোকজন তখন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সেই মানববন্ধনের ওপর হামলা চালায়। এতে উপজেলা আওয়ামী লীগের ২৫ জন এবং আক্কাছ গ্রুপের ৫ জন আহত হয়। এদের মধ্যে আশরাফুল ইসলাম বাবুল ২৬ জুন বিকাল ৪টায় মারা যান। আমরা এরই মধ্যে দ্রুত বিচার আইনে মামলা নিয়ে ৮ জনকে আটক করেছি। মেয়র আক্কাছ পলাতক রয়েছেন। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি।’