সন্তানদের নিয়ে স্বামীর সামান্য রোজগারে মোটামুটি চলছিলো সংসার। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে উড়ে নিয়ে যায় ঘরটি। জোয়ারে ভেসে যায় ঘরের সকল আসবাবপত্র। পড়ে থাকে শুধুমাত্র ক্ষতবিক্ষত ভিটেমাটি। ঝড়ের পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে আশপাশ থেকে চালের ভাঙ্গা কিছু অংশ সংগ্রহ করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে কোন রকম মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করলেও কালো মেঘের ঘনঘটায় ঝড়বৃষ্টিতে ভাঙা বিধ্বস্ত ঘরে অমানবিক বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বামী-সন্তানের জন্য খোলা আকাশের নীচে রান্না করে যাচ্ছেন গত এক মাস ধরে। ঝড়বৃষ্টিতে চুলা জালাতে না পারায় রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে অর্ধাহারে অনাহারে স্বামী ও ছোট সন্তানদের নিয়ে জুবুথুবু হয়ে দিনাতিপাত করছেন ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের লুবনা বেগম।

লুবনা বেগম (২৬) নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের পূর্ব মুন্সী গ্রামের ব্রিক ফিল্ড শ্রমিক আবুল কালামের স্ত্রী। নিঝুমদ্বীপে ঘূর্ণিঝড় রিমালের ধ্বংসলীলার এক মাস অতিবাহিত হলেও এর ধ্বংসস্তূপের চাপা থেকে এখনো সোজা হতে পারেনি লুবনার বসত তার ঘরটি। রিমালে বিধ্বস্ত ঘরটি গাছের সাথে বেঁধে রেক্সিনের চাউনি দিয়ে পরিবার পরিজনসহ রাত্রি যাপন করতে হচ্ছে তাকে। লুবনার ঘরটি মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করে দিতে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কেউ এখনো এগিয়ে আসেনি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের পূর্ব মুন্সী গ্রামে পলিথিনে মোড়ানো বিধ্বস্ত একটি ঝুপড়ি ঘর। ঘরের কাছে গিয়ে দেখা যায় একজন মহিলা দুপুরের ভাত রান্না করছে একেবারে খোলা আকাশের নিচে। নাম জিজ্ঞেস করলে জানান লুবনা বেগম। তার স্বামী আবুল কালাম ব্রিক ফিল্ড শ্রমিক। বর্তমানে ব্রিকফিল্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে নদীতে মাছ ধরে কোন রকমে জীবিকা চালাচ্ছেন। স্বামীর আয় রোজগার নাই বললেই চলে। একবেলা রান্না করে তিন বেলার খাবার কোনমতে আধাপেটে চালিয়ে নিচ্ছেন।

লুবনা বেগম রিমালে বিধ্বস্ত হওয়া ঘরটি এখনো মেরামত করতে না পেরে এক অমানবিক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। রিমাল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ঘরে থাকা কিছু চাউল ও অন্যান্য মাল ছামানা, কাপড়-চোপড় সব তছনছ হয়ে ভেসে যায়। ভাঙা ঘরের চাল ও বেড়ার অংশ বিশেষ রেক্সিন দিয়ে ঢেকে তা রশি দিয়ে বেঁধে তার নিচে একটি চকিতে ২ ছেলে ৩ মেয়ে সন্তানসহ দিন অতিবাহিত করছেন গত প্রায় এক মাস ধরে।

লুবনা বলেন, এখন বর্ষা কাল। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আকাশে যখন মেঘ ধরে তখন ছেলে-মেয়েদের কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। চারিদিকে তখন অন্ধকারময় এক ভয়ানক বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আল্লাহর নাম ডাকা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কারো কাছে কোন প্রকার সুবিধা না পেলে সামনের অনাগত দিনগুলোতে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। কেননা আগামীতে আরও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। আগত দিনগুলোতে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কিভাবে কাটবে সে চিন্তায় বর্তমানে এক চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্যে আমাদের দিন কাটছে। আমার স্বামীরও অর্থ সম্পদ নাই যে এরকম অবস্থা থেকে উন্নতি করা। আল্লাহ কেন যে বাঁচিয়ে রাখছে! মরে গেলে এমন কষ্টের পরিস্থিতি দেখতে হতো না।

লুবনা বেগম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিনে দেখতে এসে হাতিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আশিক আলী আমার ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরটি দেখেন। আমার হাতে তাৎক্ষনিক তিনি দুই হাজার টাকা তুলে দেন। এছাড়াও সরকারি বরাদ্দের ১০ কেজি চাউল ও সামান্য নগদ টাকা পাই। কিন্তু এরপর আর কোন রকমের সাহায্য সহযোগিতা কারো কাছ থেকে পাওয়া যায় নাই।

ঘূর্ণিঝড় রিমালে নিঝুমদ্বীপের ৯নং ওয়ার্ডের মুন্সিগ্রামের মিলনের ঘরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল জোয়ারের আঘাতে জর্জরিত মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা ঘরটি মোটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে মাছ ধরার কাজ করে। বর্তমানে তার আয়-রোজগার নাই বললেই চলে। একই ওয়ার্ডের রিমাল ঘূর্ণিঝড়ে সমীরের (৩০) ঘরটির চাল উড়ে গিয়ে গাছের মগডালে গিয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত সে তার ঘরটি মেরামত করতে পারেনি। তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। এধরনের ক্ষতিগ্রস্ত আরও অনেক ঘরের গৃহস্থদের কষ্টদায়ক দুর্ভোগের চিত্র ফুটে উঠে রিমালে ভুক্তভোগীদের মাঝে।

এলাকার ইউপি সদস্য চাঁন মিয়া সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমার ৯ নং ওয়ার্ডে অন্যান্য ওয়ার্ডের চেয়ে অনেক বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারি ভাবে যদি কোন বরাদ্দ আসে অবশ্যই লুবনা বেগমের ঘরটি পুনর্নির্মাণে অগ্রাধিকার পাবে।

লুবনা বেগমের বিধ্বস্ত ঘরের পুনর্নির্মাণ বিষয়ে নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন বলেন, ইতোমধ্যে লুবনার ঘরটির মেরামতের জন্য টিনসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রীর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। শীঘ্রই ঘর মেরামতের কাজ শুরু করা যাবে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে হাতিয়ায় যে কয়টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের এই নিঝুমদ্বীপ।