কৃষকদের ধান রক্ষার জন্য প্রায় ৩৫ বছর ধরে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ড্রেজারের মাধ্যমে নদী থেকে তোলা বালু দিয়ে তৈরি করা হয় অস্থায়ী রাউতারা রিং বাঁধ। ৩টি জেলার হাজার হাজার হেক্টর ধান রক্ষায় প্রতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড এই বাঁধে ব্যায় করে কোটি কোটি টাকা। সেই সাথে চলে পুকুরচুরি। অথচ একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করলে প্রতি বছর সরকারের এতো পরিমাণ টাকা জলে যেত না।

নির্মিত এই রিং বাঁধে বরাবরই রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। বাঁধে যে পরিমান মাটি ও বালি ফালানোর কথা, তা বাঁধে ফালানো হয় না কোন বছরই। প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় বাঁধ নির্মানে চলে নানা অনিয়ম দূর্নীতি। বাঁধ নির্মানের নামে বছরের পর বছর ধরে চলছে সরকারি টাকার হরিলুট। এটা যেন অনেকের বাৎসরিক আয়ের উৎস হয়ে দাড়িয়েছে। যেন দেখার কেউ নেই।

জানা যায়, পোতাজিয়া ইউনিয়নের রাউতারা সুইস গেটের পশ্চিম পাশে ১ হাজার ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ বাঁধ নির্মাণে এ বছর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। স্থানীয় কৃষকদের ধান রক্ষার নামে বালু দিয়ে অস্থায়ী এ বাঁধ নির্মাণ ও ভাঙার কাজ চলছে বছরের পর বছর। যদিও প্রতি বছরই বাঁধটি নির্মাণের এক থেকে দেড় মাসের মাথায় মাছ আহরণ ও নৌকা চালানোর সুবিধার জন্য অদৃশ্য শক্তির ইশারায় কেটে দেয় স্থানীয় মৎস্য শিকারি ও নৌযান শ্রমিকরা। এভাবে বছরের পর বছর ধরে চলছে বাঁধটি ভাঙা ও গড়ার কাজ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর তথা চলনবিলের হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমির ধান রক্ষার্থে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যা ১৯৮০ সালে শেষ হয়। কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত বাঁধটি ১৯৮৮ সালে দেশব্যাপী ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যায় বাঘাবাড়ি-নিমাইচড়া অংশের রাউতারা সুইস গেটের পশ্চিম পাশে ভেঙে যায়। সেই থেকে প্রতি বছর এই অঞ্চলের কৃষি জমির ধান রক্ষায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে এই স্থানে বালি দিয়ে রিং বাঁধ তৈরি করে। বাঁধটির নির্মাণ কাজ মার্চ মাসে শুরু হয় এবং বাঁধের স্থায়ীত্ব ২৮ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। নির্মাণ শেষে বাঁধের এ অংশ ভেঙে না গেলেও প্রতি বছর জুন মাস শেষে মাছ আহরণ ও নৌকা চালানোর সুবিধার জন্য কেটে দেন মৎস্য শিকারি ও নৌযান শ্রমিকেরা। এতে চোখের সামনে সরকারের কোটি টাকা জলে ভেসে যায়। আর স্থানীয়রা বাঁধের পাইলিংয়ের বাঁশ, খুঁটি ও বালুর বস্তা লুট করে বিক্রি করে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন কঠোর নজরদারি করলে বাঁধটি সহজেই রক্ষা করা যায়।

এলাকাবাসী ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও পাবনাসহ চলনবিল এলাকার প্রায় ৬২ হাজার ৫’শ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়। অনেক সময় নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই বাঁধের কিছু অংশে ভাঙণের সৃষ্টি হয়। এতে আমাদের উৎপাদিত ধান অনেক সময় পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে ধান কেটে ঘরে তোলা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। অনেক সময় ধান কাটা সম্ভব হয় না। প্রতি বছরই আমরা এই বাঁধ নিয়ে শঙ্কিত থাকি। এবার পানি কম থাকায় ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে। এলাকাবাসী সেখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও দুর্নীতি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এবিষয়ে উপজেলা বাসদ এর যুগ্নসাধারন সম্পাদক ও চরা চিথুলিয়া গ্রামের আব্দুল আলিম ফকির জানান, নিমাইচরা বাঁধটি নির্মান করা হয়েছিল উত্তর পাশের সব জমিগুলো ত্রিফসলী জমির আওতায় আনার জন্য। লুটপাটের কৌশল অবলম্বনের জন্য ১৯৮৮ সালের পর থেকে প্রতিবারই নিন্মমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মান করা হয়। এছাড়াও রাউতারা সইস গেটটিও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। সুইস গেটটি সংরক্ষনসহ একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করার দাবী জানান।

এ বিষয়ে পোতাজিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর জাহান বাচ্চু বলেন, এখানে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মান হলে দুই ফসলী জমিতে বহুমাত্রিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। তাই তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এখানে একটি স্থায়ী বাঁধসহ একটা পাম্প হাউজ নির্মাণের আশুদৃষ্টি কামনা করেন।

সিরাজগঞ্জ জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইমতিয়াজ আহম্মেদ এর কাছে বালু দিয়ে অস্থায়ী বাধ নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার প্রাক্কলনে বালু দিয়েই বাঁধ নির্মান সম্পর্ন করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। সেই মোতাবেক কাজ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, স্থায়ী বাধ নির্মাণের জন্য বৃহত্তর পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং স্থায়ী বাধ নির্মাণের জন্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।

অথচ একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মান করা হলে শাহজাদপুরসহ চলনবিলের এক ফসলী জমিতে ১২ মাসই বহুমাত্রিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল।

বার্তাবাজার/রাআ