ছাগল-কাণ্ডে আলোচিত মতিউর রহমান এখন থেকে ১৭ বছর আগে রাজস্ব প্রশাসনের একজন মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা হয়েও যে কতটা প্রভাবশালী ছিলেন, সে সম্পর্কে লিখেছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান। তাঁর বদলি ঠেকাতে তৎপর হয়েছিলেন ১/১১–এর সময়কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত জেনারেল মইন উ আহমেদ পর্যন্ত।

এনবিআরের একজন সদস্য ছিলেন বিসিএস শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারের কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তাঁর পদায়ন ছিল কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। পাশাপাশি তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও ছিলেন। এই দুই পদ থেকেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে এখন সংযুক্ত করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি)।

মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাঁর এক পুত্রের ছাগল কেনাকে কেন্দ্র করে। একটি খামার থেকে ১৫ লাখ টাকায় পুত্রটি ছাগল কিনেছেন—এমন খবর প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। পরে গণমাধ্যমে খবর বের হয় যে কেবল ছাগল নয়, লাখ লাখ টাকা খরচ করে ওই পুত্র কোরবানির পশু কিনেছেন। এরই জেরে বেরিয়ে আসে মতিউর রহমানের বিপুল অর্থবিত্তের কাহিনি।

বদিউর রহমান এনবিআরের চেয়ারম্যান ছিলেন ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। সময়টা ছিল সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। মতিউর রহমান তখন কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার। তাঁর চাকরিস্থল ছিল চট্টগ্রাম। বদিউর রহমান লিখেছেন, রাজস্ব প্রশাসনে গতি আনতে তাঁর চেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি কিছু কর্মকর্তাকে বদলি করেছিলেন, যার একজন ছিলেন মতিউর রহমান।

‘সরকারি চাকুরিতে আমার অনুভূতি সমগ্র’ বইয়ের ‘কোদালকে কোদাল বলি’ শীর্ষক ষষ্ঠ অংশে বদিউর রহমান লেখেন, বদলি করা হবে, এমন কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে বোর্ডে কাস্টমস ক্যাডারের সংশ্লিষ্ট চার সদস্যের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। ওই আলোচনায় জানান যে যুগ্ম কমিশনার মতিউর রহমানকে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে বদলি করার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বদিউর রহমান লেখেন, ‘আমি তাজ্জব হয়ে যাই, তার চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে বদলির কথা বলতেই কাস্টমসের চার সদস্য একসাথে তাদের একটা অভিমত ব্যক্ত করলেন যে মতিউরকে যেন না নাড়াই। কারণ জিজ্ঞেস করে আমি আরও তাজ্জব বনে যাই। তাঁরা আমাকে জানালেন যে এই কর্মকর্তা বড়ই প্রভাবশালী।’

এনবিআরের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে বলা হলো, অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় ক্ষমতাধর অনেকের সঙ্গে মতিউর রহমানের দহরম-মহরম আছে। তাঁকে বদলি করে ওই আদেশ বহাল রাখা সম্ভব হবে না।

‘তাঁরা তার ক্ষমতার ইঙ্গিত দিয়ে এ-ও বললেন যে অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের বেডরুম পর্যন্ত যেমন তিনি (মতিউর) যেতে পেরেছেন, তেমনি অর্থমন্ত্রী সাইফুরের বেডরুমেও তিনি অবাধে প্রবেশ করতে পারতেন। এমনকি সাইফুরের স্ত্রী-বিয়োগে কবরস্থানে এ কর্মকর্তা কান্নাকাটিও করেছেন। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে চার সদস্যের একই সুরে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি।’

বদিউর রহমান জানান, মতিউরকে ঘাঁটানো ঠিক হবে না এবং বদলির আদেশ বাতিল করতে হবে—এনবিআর সদস্যদের এই পরামর্শের পরও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং বদলির আদেশ জারি করেন। তবে এরপর তিনি টের পান, মতিউর রহমান তদবির করার ক্ষেত্রে ঠিক কতটা ‘ক্ষমতাশালী’।

বইয়ে তিনি লেখেন, ‘ভিন্ন এক চাকরি থেকে কাস্টমস ক্যাডারে এসেও এ মতিউর যে কত করিৎকর্মা হয়ে উঠেছে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ দেখলাম তার রাজশাহীতে বদলি বাতিলের তদবিরের চাপ দেখে। সেনা-নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই মেয়াদে সেনা-তদবির উপেক্ষা করা তো অনেকের জন্য রীতিমতো নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার শামিল।’

পরে যা ঘটেছে, তা নিয়ে বিস্তারিত জানান বদিউর রহমান। জানান, চট্টগ্রামের ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার এক সেনা কর্মকর্তা মতিউরের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য তাঁকে অনুরোধ করে টেলিফোন করেন। তাঁকে এবং চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফরিদকে (পুরো নাম বইয়ে উল্লেখ করা হয়নি) তাঁদের সিদ্ধান্ত ছাড়া রিলিজ না করার লিখিত আদেশও স্থানীয় পর্যায়ে সেনা কর্মকর্তারা জারি করেছিলেন।

পরে কাস্টমস কমিশনারকে ছাড়তে রাজি হলেও মতিউর রহমানের জন্য ‘আরও বেশি গোঁ ধরেন’ তাঁরা। তখন বদলির বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান। পরে ওই সেনা কর্মকর্তা বদিউর রহমানে সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জারি করা আদেশের জন্য ক্ষমা চান, তবে মতিউর রহমানকে চট্টগ্রামে রাখতে আবারও অনুরোধ করেন। পরে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন থেকেও অনুরোধপত্র পাঠানো হয়।

বদিউর রহমান এরপর লেখেন, ‘আমার অবাক হওয়া শেষ হয় না। তৎকালীন সিজিএস মেজর জেনারেল সিনা ইবনে জামালীও টেলিফোন করেন, আমি রাজি না হলে সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে বলেন। আমি আরও অবাক হলাম, সেনাপ্রধান মইন উদ্দীনও দেখি মতিউরকে চট্টগ্রামে রাখার অনুরোধ করলেন।’

বইয়ে লেখা হয়েছে, এনবিআর চেয়ারম্যান বদলির আদেশ প্রত্যাহার করতে রাজি না হলে সেনাপ্রধান আলোচনার শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘আমার একটামাত্র অনুরোধ কি রাখবেন না?’ ‘মতিউরের বদলির আদেশ আমি বাতিল করিনি’—জানান বদিউর রহমান।

‘মতিউরের তদবিরের ধার ছিল, তার তদবিরের চাপ প্রচণ্ড ছিল। তখনকার তিন উদ্দীনের রাজত্বের মধ্যে এক নম্বর এবং বাস্তবে একমাত্র ক্ষমতাশালী উদ্দীন মইন উদ্দীন আমার চেয়ারম্যানের মেয়াদে আমার কাছে বদলির একটিমাত্র তদবির করেছিলেন। আর সেই তদবির ছিল মতিউরের রাজশাহীর বদলি আদেশ বাতিল করা।’
বদিউর রহমান তাঁর বইয়ে লেখেন, তিনি এনবিআর থেকে চলে যাওয়ার পর মতিউর রহমানকে আবার চট্টগ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।