পরিবারের হাল ধরতে বেইলি রোডের ওয়াফিয়া জুস বার অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে সহকারি সেফের কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের শান্ত হোসেন। ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশুনার খরচ যোগাতে নিজের স্বপ্ন বিকিয়ে দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন এই কাজে। তবে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি, ফিরেছেন লাশ হয়ে। কর্মক্ষম সন্তান হারিয়ে পরিবারটিতে বইছে শোকের মাতম।
বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের বহুতল ভবনের নিচতলায় গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। মর্মান্তিক সেই দূর্ঘটনায় আগনে পুড়ে ও প্রচন্ড ধোয়ার কারণে মোট ৪৬ জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে শান্তর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। শুক্রবার জুম্মার পর তার জানাজা শেষে তাকে ভুইগর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাারয়ণগঞ্জের ভুইগর পশ্চিম পাড়ার সৌদি প্রবাসী আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে শান্ত। পরিবারের ঋণ থাকায় প্রবাসী আমজাদের আয়ে সংসার চলতো টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে। তাই তার বড় ছেলে শান্ত নিজের পড়াশুনাকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারের হাল ধরতে ও কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই আর স্কুল পড়ুয়া ছোটবোনকে উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বেইলি রোডের সেই আগুনে শুধু পোড়েনি শান্ত, পুরেছে পুরো পরিবারের স্বপ্ন। পরিবার-প্রতিবেশীদের নিরব দৃষ্টি আর ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে থাকাই বলে দিচ্ছে কেউই যেন এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। সন্তান হারানো মায়ের গগণবিদারী আহাজারী আর শোকের মাতমে স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো এলাকা।
বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় নিহত শান্তর বন্ধু নাজমুল হাসান শান্ত বলেন, আমার বন্ধু খুবই পরিশ্রমী মানুষ ছিল। সে তার স্বপ্নকে মাটি দিয়ে ছোট দুই ভাইবোনের জন্য জব করতো। শুধু তাই না এক কথায় বলতে গেলে এই বয়সে পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিল সে। অথচ আজকে সব স্বপ্ন বুকে নিয়ে চিরবিদায় নিল আমার বন্ধু। তার এই চলে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারছি না।
তিনি আরো যোগ করেন, দেখেন বাংলাদেশে এই কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ধরণের আগুনের ঘটনা ঘটেছে। নিমতলী ট্রাজেডি, রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানায় আগুন, চট্টগ্রামের কনটেইনার কারখানার আগুন কিংবা বঙ্গবাজারের আগুনও আমাদের সতর্ক করতে পারেনি। আসলে আর কত লাশের সারি দীর্ঘ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙবে। প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি করে কোন একটি পক্ষকে দোষারোপ করা হয়। এতে কি স্বজন হারানোর যন্ত্রণা ঘুচে। ঘটনার আগেই যদি সচেতন হয়ে আমাদের ত্রটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হয় তবে এতটা ক্ষতি হতো না।
নিহত শান্তর ছোট ভাই কবি নজরুল কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী প্রান্ত হোসেন বলেন, পারিবারিক ঋণ থাকায় বাবার আয়ে সংসারের খরচ চললেও আমাদের দুই ভাই-বোনের পড়াশুনার খরচ যোগানো ছিল কষ্টসাধ্য। এমন পরিস্থিতিতে শান্ত ভাই নিজে পড়াশুনা না করে এই বয়সে জব শুরু করেন। আমাদের নিয়ে তার বড় স্বপ্ন ছিল। কাল সন্ধায় কল দিয়ে জানিয়েছে আজ ছুটি নিয়েছে, বাড়ি আসবে। এই মাসের শেষের দিকে আমাদের নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে। কিন্তু বেইলি রোডের সেই আগুন আমার ভাইকে চিরদিনের মত ছুটি দিয়ে দিল।
এদিকে সন্তান হারিয়ে আহাজারীতে ভেঙ্গে পড়া শান্তর মা লিপি আক্তার জানান, আমার ছেলের সাথে ঘটনার দিন সন্ধায় কথা হয়েছে। সব সময় অডিও কল দিলেও গতকাল ভিডিও কল দিয়েছিল। ছোট ভাই-বোনের পড়াশুনার খবর নিল। আমার সাথে কথা বললো। ভাবি নাই আমার মানিকরে এইবারের মতই শেষ বার দেখবো।
ই.এক্স/ও.আর/বার্তা বাজার