বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত কয়েকদিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে দেশের অন্যতম বীমা প্রতিষ্ঠান সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছে মীর রাশেদ বিন আমানের দুর্নীতির নানা খতিয়ান। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস সিইও’র বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ আমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে সোনালী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান ফাউজিয়া কামরান তানিয়া স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত অভিযোগে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে এসে মীর রাশেদ বিন আমান শ্বশুরের প্রতিষ্ঠিত সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও পদে বসেন। এরপর এই পদ ব্যবহার করে দুর্নীতি, নানা অনিয়ম ও নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব ঘটনা, কোম্পানির তহবিল থেকে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন রাশেদ আমান। কর্মচারীদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ও দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দিতে তার বিরুদ্ধে করপোরেট রেকর্ড হেরফের করার মতো গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির পক্ষ থেকে মূল অভিযোগ সদ্য বহিষ্কৃত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমানের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে কোম্পানির পক্ষ থেকে রাশেদ বিন আমান ও তার দুর্নীতির সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ মোস্তফা গোলাম এমরান বাদী হয়ে রামপুরা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এতে মীর রাশেদ বিন আমান’সহ কোম্পানির সাবেক সাত কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে অর্থ আত্মসাৎসহ হুমকি প্রদানের অপরাধে পেনাল কোড ১৮৬০ এবং দন্ডবিধির ৪০৮/৪২০/৫০৬ ধারায় মামলা রুজু করা হয় (মামলা নং-৪ তারিখ ১১/০১/২০২৪)। এই মামলায় ইতোমধ্যে রাশেদ’সহ সাত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

আসামিরা হলেন, মীর রাশেদ বিন আমান, সোনালী লাইফের সাবেক এইচআর অফিসার ফাতেমা তামান্না সুইটি, হিসাব বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা সুমি শেন, সাবেক হেড অব পারচেজ রাজেশ আইস, সাবেক হেড অব ফাইন্যান্স মো. বোরহান উদ্দিন মজুমদার, হিসাব বিভাগের সাবেক ম্যানেজার মো. শিপন ভূঁইয়া ও সাবেক হেড অব ইনভেস্টমেন্ট সুজন তালুকদার।

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অভ্যন্তরীণ তদন্তে জানা গেছে, কোম্পানির তহবিল থেকে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন রাশেদ আমান। কর্মচারীদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ও দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দিতে তার বিরুদ্ধে করপোরেট রেকর্ড হেরফের করার মতো গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে।

এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের টাকা নিয়ে নয়-ছয় করারও অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে গণমাধ্যমকর্মী রয়েছেন বলে জানা গেছে। এতে গ্রাহকরা ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।

যদিও শুরু থেকেই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন মীর রাশেদ বিন আমান। উল্টো নিজের অপরাধ ঢাকতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে কোম্পানির চেয়ারম্যান’সহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন বলে দাবি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের।

এদিকে অর্থ আত্মসাৎ এর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে রাশেদ বিন আমান এর নৈতিক স্খলনের আরও বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। পাওয়া গেছে একাধিক নারীর সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের ছবি ও ভিডিও। ফাঁস হয়েছে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে গোপনে কোম্পানির সাবেক কর্মী ফাতেমা তামান্না সুইটিকে বিয়ের তথ্য।

কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে, আভ্যন্তরীণ তদন্ত চলাকালে মীর রাশেদের দপ্তরে পাওয়া গেছে সই জালিয়াতি করা অসংখ্য ব্ল্যাংক চেক। যেগুলোর মাধ্যমে কোম্পানির তহবিল থেকে আরও বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।

কোম্পানি থেকে পাওয়া মাসে সাড়ে চার লাখ টাকা বেতনের বাইরে আয়ের আর কোনো উৎস না থাকলেও তিনি ব্যবহার করেন একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। দ্বিতীয় স্ত্রী সুইটিকে ঢাকায় কিনে দিয়েছেন বিলাসী ফ্ল্যাট ও দামি গাড়ি। এমনকি অর্থপাচারের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় চারটি অ্যার্পাটমেন্ট ও মার্সিডিজ জি ওয়াগন-২০২১ মডেলের দামি গাড়ি কিনেছেন বলেও জানা গেছে।

এদিকে, কোম্পানির পক্ষ থেকে নিয়োগ করা তৃতীয় পক্ষের তদন্ত এবং রাশেদের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রাহক বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ এড়াতে পদত্যাগ করেছেন সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। গত ১৮ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের সভায় মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস পদত্যাগ পত্র জমা দেন বলে কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে।

এ দিকে মীর রাশেদের দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে সোনালী লাইফের পক্ষ থেকে একটি আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা হয়েছে।
যদিও শুরু থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন মীর রাশেদ বিন আমান। উল্টো তিনি অভিযোগ করছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান’সহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বিষয়গুলো বিস্তারিত জানতে তাকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য যে, সোনালী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস কোম্পানির পক্ষ থেকে নিয়োগ করা তৃতীয় পক্ষের তদন্ত এবং রাশেদের অভিযোগের ভিত্তিতে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। গত ১৮ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদ সভায় তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।

দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘স্বচ্ছতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সততা ও সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে আমি পদত্যাগ করেছি। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিরীক্ষা কার্যক্রম নিবির্ঘ্ন করার পাশাপাশি তদন্ত চলাকালীন কোনো প্রভাব বিস্তার না করে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য আমি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছি।

বার্তা বাজার/জে আই