বগুড়ার শেরপুরে কেল্লাপোশী মেলা ২৮ মে রবিবার থেকে শুরু হয়েছে। তিথি অনুযায়ি প্রতিবছর জ্যেষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার থেকে মেলা শুরু চলে তিনদিন। মেলাটি শুরু হলেও আরও সপ্তাহখানেক আগে থেকে গ্রামের মানুষদের মাঝে আমেজ দেখা দেয়। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘মাদারের মেলা’ ও ‘জামাইবরণ’ মেলা নামেও পরিচিত। তবে এ মেলাটিকে যে যেই নামেই ডাকুক না কেন? সকলে বিশ্বাস করে যে এই মেলাটিই এই ‘মেলার রাজা’। তাইতো স্থানীয় ও আশপাশের মানুষ থেকে শুরু করে বহু দূর থেকেও অনেকে ছুটে আসেন এই মেলায়।

‘মেলার রাজা’ খ্যাত এই মেলা শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। প্রায় ৫০০ বছর থেকে বগুড়ার শেরপুরে কেল্লাপোশী নামক স্থানে এ মেলা বসছে। এবার বেশ জমজমাট মেলা হবে বলে আশাবাদি আয়োজক কমিটিরা।

কথিত আছে ১৫৫৬ সাল থেকে কেল্লাপোশীতে এ মেলা হয়ে আসছে। এর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি গাজী পিরের কিচ্ছার ঐতিহ্য জড়িত।

জনশ্রুতিতে জানা যায়, বৈরাগনগরের বাদশা সেকেন্দারের ছেলে ছিলেন গাজী মিয়া। আর কালু মিয়া ছিলেন তাঁর দত্তক পুত্র। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তাঁরা দুই ভাই রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির-সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণনগরে আসেন। ব্রাহ্মণ রাজা মুকুটের ছিল সাত পুত্র ও এক কন্যা চম্পাবতী। বাংলা সাহিত্যে যা ‘সাত ভাই চম্পা’ নামে পরিচিত। চম্পাবতী গাজীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার কাছে যান।

মুকুট রাজা ছিলেন যবনদ্বেষী ব্রাহ্মণ। কালু ঘটক হিসেবে রাজা মুকুট রায়ের দরবারে গিয়ে গাজীর সঙ্গে চম্পাবতীর বিয়ের কথা উত্থাপন করলে কালু বন্দী হন। ফলে গাজীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধল মুকুট রাজার। মুকুট রাজার কাছ থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য গাজী মিয়া কেল্লাপোশী নামক একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। যুদ্ধে রাজা মুকুটের পরাজয় ঘটে। গাজী ও চম্পাবতী পরিণয়ে আবদ্ধ হন।

গাজী ও চম্পাবতীর সেই শুভ পরিণয় হয়েছিল জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দুর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। তখন থেকেই চলে আসছে এ মেলা।

এই মেলা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে থাকে নানা আয়োজন। এরই একটি হচ্ছে মাদার খেলা। মেলা শুরুর সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে এ খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রঙে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানা সরঞ্জাম আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের পাড়া-মহল্লাতেও খেলা দেখায়। দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার তা শেষ করে।

আর এ মেলাকে কেন্দ্র করে আনন্দ উল্লাস আর উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় থাকে লাখো মানুষ। তারা প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে দাওয়াত দিচ্ছেন। নিমন্ত্রণে থাকে নতুন-পুরনো জামাই-বউ রয়েছেন তালিকার শীর্ষে।

শ্বশুরালয়ে আসা জামাইরা থাকেন ভিন্ন মৌজে। কারণ মেলা করতে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের সেলামি। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইবাবুরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুরবাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন সামগ্রী, সবচেয়ে বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাদের সার্কাস, নাগোরদেলা, হুন্ডা খেলা, জাদু খেলা, পুতুল নাচ দেখিয়ে দিনব্যাপী আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরি খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন।

শেরপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে কুসুম্বী ইউনিয়নে অবস্থিত কেল্লা-পোশী গ্রামে ৩ দিনব্যাপী এ মেলায় সার্কাস, নাগোরদোলা, পুতুল নাচ, বিচিত্রা, হোন্ডাখেলা, কারখেলাসহ নানা অনুষ্ঠান চলে। সেই সঙ্গে জুয়াড়িরা পাল্লা দিয়ে মেলা দেখতে আসা সহজ সরল মানুষকে ঠকিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটার ধুম। দূরদূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন।

উপজেলার কেল্লাপোশী বাজার এলাকার শাহাদত হোসেন বাদশা নামে গ্রামবাসী জানান, মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগ থেকেই গ্রামের লোকজন নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই ভিন্ন আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে জামাই বাবুকে মোটা অঙ্কের সেলামীও দেওয়া হয়।

এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুঠির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। আর মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের আসবাবপত্র, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারাবছরের জন্য কিনে রাখেন গ্রামের সাধারণ মানুষও।

যেহেতু মেলাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটে, তাই সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের বিশে টহলের ব্যবস্থার কমতি থাকেনা। এমনটাই অবগত হয়ে শেরপুর থানার নবাগত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নব কুমার সাহা বলেন, ‘মেলাটি ঐতিহ্যবাহী জেনেছি, সেই সাথে ওই অশ্লীল যাত্রা, জুয়া বা বিচিত্রা অনুষ্ঠানও হত বলে অবগতি হয়েছি। কিন্তু এবার তা হবে না। তাছাড়া মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে থানা পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।

বার্তাবাজার/এমআই