ছবির মত সাজানো এক গ্রাম। গাছপালা ঘেরা শান্ত-সুনিবিড়ি পরিবেশের মাঝে ভেসে আসে শিশুদের মিষ্টি কণ্ঠে ছড়া কাটার শব্দ। আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে টিনের চালার একটি ঘরের। আর সেখানে বসে ২০-২৫ জন শিশু মনের আনন্দে কবিতা আবৃত্তি করছে। ঘরটির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে কচি হাতে আঁকা নানা ছবি। রয়েছে সচেতনতামূলক বাণী। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শিশুদের বই, শিক্ষামূলক নানা খেলার উপকরণ। ঘরটির ঠিক মাঝখানে বসে শিশুদের গল্প, কবিতা আর গানেছলে অত্মরক্ষার কৌশল শেখাচ্ছেন প্রশিক্ষিত ‘আঁচল মা’। নাম তার সাথী । বলছি বেতাগী উপজেলার ৬নং কাজিরাবাদ ইউনিয়নের চান্দখালী এলাকার কথা।

এ এলাকায় বেশিরভাগ বসতবাড়ির সাথেই রয়েছে পুকুর। কিছুদুর পর পরই ডোবা আর খাল-বিল। গ্রামের শান্ত নিবিড় পরিবেশে এ দৃশ্য মনোমুগ্ধকর হলেও এর পেছনের গল্পটা ভয়াবহ। প্রতিবছর কেড়ে নিচ্ছে অনেক শিশুর প্রাণ। ১ মিনিট আগেও খেলতে থাকা শিশুটি মায়ের বুক খালি করে মুহূর্তে হারিয়ে যাচ্ছে অতল জলের গভীরে । বাবা-মায়ের কাছে গল্প হয়ে যাচ্ছে তরতাজা একটি প্রাণ।

ছবি: বার্তা বাজার

এ গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে সন্তান হারানোর সেসব বেদনাদায়ক গল্প। এসব শিশুদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছে ‘আঁচল’। এই দিবাযত্ন কেন্দ্রটি ১ বছর থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের লালনপালন করছে। শেখাচ্ছে পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধের নানা কৌশল। অভিভাবকরা মনে করছেন আঁচলের তলে নিরাপদে বিকশিত হচ্ছে এ গ্রামের শিশুরা। তত্ত্বাবধানকারী নারীকে শিশুরা ডাকে ‘আঁচল মা’ বলে। শিশুমৃত্যু রোধে এমন নজির স্থাপন করেছে বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুমৃত্যু রোধে কাজ করছে।

আঁচলে দেখা মেলে কয়েকজন মায়ের। আঁচল মায়ের পরামর্শে বাচ্চাকে সেখানে দিয়েছেন তারা। তারা বলেন, বাসায় অনেক কাজ করতে হয়। সেসময় বাচ্চারা পানিতে পড়ার ভয় থাকে। বাড়ির সবাই অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। আমার বাচ্চাটা যাতে সেসময় নিরাপদ থাকে সেজন্য এখানে দেয়া।”

ছবি: বার্তা বাজার

আরেক শিশুর মা বলেন, “কাজে ব্যস্ত থাকায় বাচ্চা পানিতে পড়ে নাকি আগুনে পড়ে, নাকি দৌড়ে রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে সবসময় খেয়াল রাখা সম্ভব হয় না। আঁচল হয়ে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। যে সময় বাচ্চা এখানে থাকে সেই সময়ের মধ্যে ঘরের সব কাজ শেষ করতে পারি। এরপর বাচ্চা বাসায় গেলে সময়মত তাদের গোসল করিয়ে খাবার দিতে পারি।

এ বিষয়ে কাজিরাবাদ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন মাহামুদ সুমন বার্তা বাজার’কে বলেন, এসব কেন্দ্রগুলির চালু হওয়ার পর দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও অনেক কমে গেছে। অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মেশার সুযোগ থাকায় ছোট ছোট শিশুরা এসব কেন্দ্রে যেতেও বেশ আগ্রহী।

এ বিষয়ে এরিয়া কো-অর্ডিনেটর প্রোজেক্ট ভাসা, সিআইপিআরবি রজত জ্যোতি সেন বার্তা বাজার’কে বলেন, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মায়েরা রান্না ও পারিবারিক অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া এ সময়ে শিশুর ভাই, বোনও স্কুলে থাকে। ফলে এ সময়টা শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ সময়টিতে শিশুদের সুরক্ষা দিতে গঠিত হয় আঁচল কেন্দ্র। আঁচল কেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকে দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যু অনেক হ্রাস পেয়েছে। শিশুরা এখান থেকে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পাচ্ছে। ‘আঁচল’ কেন্দ্রে বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে অন্য কাজকর্ম করতে পারছেন অভিভাবকরা।

বার্তাবাজার/এম আই