বিআরটিএ এর সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’ এর পেমেন্ট গেটওয়ের দুর্বলতা জেনে হ্যাকিং সফওয়ার তৈরি করে কম্পিউটার প্রকৌশলী শাহরিয়ার। এরপর দালাল ও চক্রের অন্য সদস্যদের যোগসাজশে গত ১২ এপ্রিল হতে ১০ মে নকল কোড ব্যবহার করে ৩৮৯টি মানি রিসিপ্ট প্রস্তুতের মাধ্যমে সরকারি প্রায় সোয়া কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

শুধু তাই নয়, এর আগে ২০২২ সালের নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে চক্রটি ডেসকো কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাক করে ট্রানজেকশন আইডি তৈরী করে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

বিআরটিএ এর প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সিএনএস গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, লাইসেন্স নবায়নসহ বিভিন্ন কাজে গ্রাহকদের নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ করে।

এক মাসে প্রতারণামূলকভাবে কোটি টাকার অধিক সরকারী অর্থ আত্মসাতের মূলহোতা কম্পিউটার প্রকৌশলী শাহরিয়ার ও তার অন্যতম সহযোগী আজিমসহ জড়িত ৬ জনকে রাজধানীর কাফরুল, মিরপুর ও গাজীপুর সদর এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র‌্যাব)।

সোমবার(২২ মে) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ১০ মে ‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’ এর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, কোম্পানির মাসিক লেনদেনের বিবরণীর সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের লেনদেন বিবরণী যাচাই-বাচাই শেষে বিআরটিএ এর মোট ৩৮৯টি ট্রানজেকশনের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার গড়মিল।

সিএনএস লিমিটেড জানায়, তাদের ওয়েবসাইটে ট্রানজেকশনের পেমেন্ট স্ট্যাটাস পেইড দেখালেও মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে কোন টাকা জমা হয়নি। এ প্রেক্ষিতে ‘‘সিএনএস লিমিটেড’’ র‌্যাব-৪ এর নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। তারা দাবি করে, তাদের ওয়েবসাইট অথবা পেমেন্ট গেটওয়ে হ্যাক করে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তথ্যপ্রযুক্তিগত কার্যক্রম ও র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গত রাতে র‌্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর মিরপুর, কাফরুল ও গাজীপুর সদর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের মূলহোতা মো. শাহরিয়ার ইসলাম (২৬), সহযোগী আজীম হোসেন (২৭), শিমুল ভূঁইয়া (৩২), রুবেল মাহমুদ (৩৩), ফয়সাল আহাম্মদ (২৩), ও আনিচুর রহমান(২৩)কে গ্রেপ্তার করে।

উদ্ধার করা হয় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিপিইউ, মোবাইল ফোন, সিমকার্ড, পেনড্রাইভ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিসহ নগদ ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫৯ টাকা।

কমান্ডার মঈন বলেন, ‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভিস মিরপুরস্থ একটি সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট কোম্পানি যারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি বিষয়ক কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে।

প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) এর সঙ্গে গত ১০-১১ বছর যাবৎ চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন গাড়ীর মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফি বিভিন্ন ব্যাংক এবং অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে পরবর্তীতে বিআরটিএতে হস্তান্তরের মাধ্যমে যাবতীয় লেনদেনের কার্যাবলী সম্পাদন করে আসছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার শাহরিয়ার বিভিন্ন আন-ইথিক্যাল হ্যাকিং ম্যাথড এপ্লাই করে অভিনব কায়দায় “সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ” ওয়েবসাইট এর পেমেন্ট গেটওয়ে হ্যাক করার মাধ্যমে মানি রিসিপ্ট প্রস্তুত করত। বিভিন্ন গাড়ীর মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফিসহ বিভিন্ন কাজে অর্থ সংগ্রহ করত এবং তাদেরকে অর্থ পরিশোধের মানি রিসিপ্ট প্রদান করতো যদিও কোন টাকা সরকারি ফান্ডে জমা হতো না। গত ১২ এপ্রিল হতে ১০ মে পর্যন্ত সফটওয়্যার কর্তৃক নকল কোড ব্যবহার করে ৩৮৯টি মানি রিসিপ্ট প্রস্তুতের মাধ্যমে সরকারি সোয়া কোটি টাকা টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ্যাক করে।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, ইতোপূর্বে গত ২০২২ সালের শেষের দিকে তারা ডেসকো কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাক করে ট্রানজেকশন আইডি তৈরী করে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ডেসকো কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের ওয়েবসাইটের কিছু পরিবর্তন আনলে পেমেন্ট স্লিপে আনপেইড উল্লেখ থাকায় গ্রাহকগণ পুনরায় বিল পেমেন্ট করে।

প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে জানা যায়, তারা মাঠ পর্যায়ের গ্রাহকদের নিকট হতে বিভিন্ন গাড়ীর মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফিসহ বিভিন্ন কাজের জন নির্ধারিত ফি এবং গাড়ীর কাগজপত্র রাজধানীর মিরপুরে ‘মায়ের দোয়া বিজনেস সেন্টার’ ও ‘চাঁদপুর বিজনেস সেন্টার’ কর্তৃক গ্রহণ করতো। পরবর্তীতে গাড়ীর সকল কাগজপত্র স্ক্যান করে হ্যাকিং এর কাজে প্রস্তুতকৃত সফটওয়্যার কর্তৃক নকল কোড ব্যবহার করে তৈরিকৃত মানি রিসিপ্ট এর পিডিএফ কপি ফয়সাল ও আনিচুরের নিকট চ্যানেল মোতাবেক পাঠাতো। ফয়সাল ও আনিচুর ঐ মানি রিসিপ্ট হাতে পাওয়ার পর সেটা গ্রাহককে বুঝিয়ে দিয়ে ক্যাশ টাকা গ্রহণ করতো। এরপর গ্রাহক ঐ মানি রিসিপ্ট দিয়ে বিআরটিএ এর সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করতো।

গ্রেপ্তার শাহরিয়ার এই প্রতারণা চক্রের মূল হোতা। সে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শেষ না করে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে। বিভিন্ন আইটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সময় সে মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিং এর পেমেন্ট রেসপন্স কোড সম্পর্কে ধারণা পায়। একপর্যায়ে সে নিজেই প্রতারণার উদ্দেশ্যে একটি সফটওয়্যার তৈরী করে ও সিএনএস লিমিটেডের ওয়েবসাইটের পেমেন্ট গেটওয়ে হ্যাক করে মানি রিসিপ্ট প্রস্তুত করে।

এজন্য সে গ্রেপ্তার আজিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং আজিমকে সফটওয়্যার সম্পর্কে ধারণা দেয়। আজিমকে মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক হতে অর্থ সংগ্রহ ও উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূয়া মানি রিসিপ্ট প্রস্তুত করার সার্বিক দায়িত্ব দেয়।

আজিম প্রতারণা চক্রের মূলহোতা শাহরিয়ারের অন্যতম সহযোগী এবং পুরো প্রতারণা প্রক্রিয়ার অপারেশন প্রধান ছিল। সে মূলত প্রস্তুতকৃত সফটওয়্যার কর্তৃক নকল কোড ব্যবহার করে মানি রিসিপ্ট তৈরি ও পিডিএফ কপি শিমুলকে প্রদান করতো। ২০১৬-২০১৭ সালে গ্রাজুয়েশনের জন্য ঢাকার একটি কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যায়নরত ছিল। পরবর্তীতে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে। বর্তমানে সে একটি সফটওয়ার কোম্পানিতে কর্মরত। সে চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত শাহরিয়ার এর মাধ্যমে বিআরটিএ ও অনলাইন ব্যাংকিং প্রতারণার সাথে যুক্ত হয়।

গ্রেপ্তার শিমুল ২০১৯ সালে ঢাকার একটি কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে তিনি গত মার্চ মাসে ছুটিতে দেশে এসে গ্রেপ্তার আজিমের মাধ্যমে চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সে মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক হতে সংগৃহীত অর্থ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ভূয়া মানি রিসিপ্ট আজিমের নিকট থেকে সংগ্রহ করে ফয়সালের নিকট প্রেরণের মাধ্যমে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করত।

গ্রেপ্তার রুবেল ২০১৪ সালে হোমনার একটি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করেনি। সে গাড়ী ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। সে গ্রেপ্তার শিমুলের মাধ্যমে প্রতারণায় যুক্ত হয়।

গ্রেপ্তার ফয়সাল ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করে। সে রাজধানীর মিরপুরে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায়ী। সে গ্রেপ্তার রুবেলের মাধ্যমে প্রতারণায় যুক্ত হয়।

গ্রেপ্তার আনিচুর ২০১৮ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ভর্তি হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সে রাজধানীর মিরপুরে মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবসা করতো। সে তার ফুফাতো ভাই গ্রেপ্তার ফয়সালের মাধ্যমে চক্রে জড়ায়।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’ এর পেমেন্ট গেটওয়ের দুর্বলতা ছিল। সেটিরই সুযোগ নিয়েছে শাহরিয়ার। জিজ্ঞাসবাদে সে সেটি স্বীকার করেছে। সিএনএস লি-ও বিষয়টি স্বীকার করে এখন তাদের পেমেন্ট গেটওয়ের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কাজ করছে।

বার্তা বাজার/জে আই