৮ই মার্চ নিঝুম আপুদের লাইব্রেরিতে গিয়ে সুমন দেখে— কেউ নেই, শুধু শাওন ভাইয়া বসে আছে। সবাই কোথায়, জিজ্ঞেস করতেই শাওন বলল, বিকালে নারী দিবসের প্রোগ্রামে গেছে সবাই। ওখানেই আছে সবাই। সুমন ভাবে কত যে দিবস! নারী দিবস, শিশু দিবস, হ্যান দিবস ত্যান দিবস, দিবসে দিবসে একদম একাকার। বছরের সব দিনই মনে হয় কোন না কোন দিবস। বাবা রে! কিন্তু শাওন ভাইয়া, নারী দিবসের প্রোগ্রামে ছেলেরা কেন? সুমন জিজ্ঞেস করে শাওনকে। প্রশ্ন শুনেই শাওন খেকিয়ে উঠে বললো – অশিক্ষিত, আহাম্মক, উজবুকের মতো কথা বলবি না তো! নারী দিবসের প্রোগ্রামে ছেলে কেন! গরু কোথাকার!
অশিক্ষিত! আহাম্মক! উজবুক তারপর আবার গরু? সামান্য একটা প্রশ্নের জন্য চার-চারটা গালি! মনটা একটু খারাপই হতে চাইলো সুমনের ভাবলো চলে যাব নাকি। কিন্তু কৌতুহলই জিতলো। সুমন ভাল মানুষের মতো মুখ করে বললো –
– গত কয়েকদিন টিভি আর পেপারে তো খালি দেখি মসল্লার কোম্পানী, সেন্টের কোম্পানী, শাড়ি-গয়নার, হাড়ি-কুড়ির দোকান এরকম সবকিছুর নারী দিবসের শুভেচ্ছা। এর মধ্যে রান্নাবান্না আর সাজুগুজু ছাড়া যে অন্য কোন ব্যাপার আছে সেটা বুঝবো কি করে?
– তা ঠিক! একমত হয় শাওন।
– এত বকাবকি না করে ব্যাপারটা কি সেটা বলো না। নাম শুনে তো বোঝাই যাচ্ছে যে নারীদের জন্য যে দিবস সেটাই নারী দিবস। কিন্তু নারীদের জন্য হঠাৎ একটা দিবসের দরকার হলো কেন? কী হতো দিবসটা না থাকলে? কি লাভই বা হচ্ছে দিবসটা থাকাতে?
– বলতে পারি যদি তোর ধৈর্য্য থাকে। মাঝপথে ভেগে যেতে পারবি না! বলে শাওন। তা নয়তো এখনই ভাগ।
– না না। শুনবো শাওন ভাইয়া। তুমি বলো। কিন্তু একটু মজা করে বলো। খালি দিন তারিখ বলো না। ঘুম পেয়ে যাবে তাহলে।
– হুম! ভুরু কুচকে একটু চিন্তা করে শাওন। তো শুনবি- কিন্তু খালি দিন তারিখ না তাই তো?
– হ্যাঁ। জোড়ে জোড়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় সুমন।
– ঠিক আছে। তো কি রকম ইতিহাস শুনতে চাস সেটা বল? বিপ্লবী ইতিহাস, না এমনি এমনি ইতিহাস?
– সেটা আবার কী? নিজেকে বেকুব বেকুব মনে হয় সুমনের!
– মানে এখন নারী দিবস পৃথিবী জুড়ে পালিত হয়। এরও তো একটা শুরু ছিল নাকি? জানতে চায় শাওন।
– হ্যাঁ, তা তো থাকতেই হবে।
– তো নারী দিবসের সেই ঐতিহাসিক শুরুর ২ টা ভার্সন আছে। কোনটা শুনতে চাস সেটা বল।
– এরকম কেমনে হয় সেটাই তো বুঝতে পারছি না। শুরুতেই তুমি মাথা খারাপ করতে চাচ্ছ।
– না। হযবরল’র কাকেশ্বর কুচকুচের মতো মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় সুমন।
– দুটো গল্পই বলো। বিপ্লবী-বিপ্লবী আর এমনি-এমনি।
– দুটোই শুনবি? আচ্ছা তাহলে তোকে সবচেয়ে প্রচলিত ভার্সনটা আগে বলি, বলে আলোচনা শুরু করে শাওন।
আমাদের এখানে নারী দিবসের যে ইতিহাস মূলত বিভিন্ন অফিস আদালত এবং এনজিওগুলো বলে সেটারও কয়েকটা ভার্সন বা রূপ আছে কিন্তু সবগুলোরই শুরু হলো – ১৮৫৭ সালে ৮ই মার্চ। নিউ ইয়র্ক। সে সময়ে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা করে কাজ করতে হয়, এখন আমাদের দেশে যেমন হয় আর কি। এরকম পরিস্থিতিতে নিউ ইয়র্কে গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির নারী শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে দাবী জানিয়ে আসছে নিয়ন্ত্রিত কর্মঘন্টা, ন্যূনতম মজুরীসহ নানান বিষয়ে। এরকম পরিস্থিতিতে কর্মঘন্টা সহ নানান দাবীতে নারী শ্রমিকেরা একটা মিছিলের আয়োজন করে। যা পুলিশ বর্বরভাবে আক্রমণ করে ভেঙ্গে দেয়। অনেক নারী শ্রমিক আহত হন।
আরেকটা হলো ১৮৫৭ সালে নিউ ইয়র্কে একটা গার্মেন্টসে আগুন লেগে অনেক নারী শ্রমিক মারা যায়। যে গার্মেন্টসে আগুন লাগে সেই গার্মেন্টসের পাশে একটা মিমোসা ফুলের গাছ ছিলো। সে কারণে এই ফুল হলো নারী দিবসের প্রতীক। এই অগ্নিকান্ডের প্রতিবাদে নারী শ্রমিকেরা মিছিল করে। মিছিলে পুলিশের আক্রমণে অনেক নারী শ্রমিক আহত হন। এই ঘটনার ৫০ বছর উপলক্ষে ১৯০৭ সালে নিউইয়র্কে নারী শ্রমিকরা ৮ই মার্চ একই দাবীতে বিশাল মিছিলের আয়োজন করে। এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে নারী দিবস পালন শুরু হয়, যা এখনও চলছে। কিন্তু এই গল্পের একটা সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা? প্রশ্ন সুমনের।
– সমস্যা হলো ১৮৫৭ সালের প্রতিবাদ বা ১৯০৭ সালের ৫০ বছর পূর্তি কোনটারই কোনরকম প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু কয়েকটা ঘটনা খেয়াল রাখ, প্রথম – গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ড, দ্বিতীয় – বিশেষ একটা দিবসকে স্মরণ, তৃতীয়- নিয়ন্ত্রিত কর্মঘন্টা, বেতন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এরকম দাবীতে বিশাল একটা মিছিল। ঠিক আছে?
– আলাদা করে এগুলো বললে কেন?
– কেন এরকম হলো কি উদ্দেশ্য সেগুলো বলার আগে তোকে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বলি। এগুলোর লিখিত প্রমাণ আছে, নানা ভাবে পরীক্ষা করা যায়। আমার মনগড়া কিছু না। মন দিয়ে খেয়াল কর কারণ দিন তারিখ এবং ঘটনা শুরু হচ্ছে।
– আচ্ছা। নড়ে চড়ে বসে সুমন। আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। একারণেই তো শাওন ভাইয়ার সাথে গল্প করতে আসা!
– প্রথম নারীদের জন্য দিবস পালন হয় ১৯০৮ সালে, ১৯০৭ সালে না। দাঁড়া, একটা টেবিল আঁকি তাহলে তোর বুঝতে আর মনে রাখতে সুবিধা হবে। একটা টাইম লাইনের মতো হবে।
১৯০৬ : এই সবকিছুর শুরু, মানে নারী দিবস নিয়ে আলোচনার শুরু করা যায় ১৯০৬ সালকে ধরে। কেন এর আগে না? কারণ নারী আন্দোলনের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, কিন্তু নারীদের দিবস শুরুর আলোচনাটা এখান থেকে করার কারণ ১৯০৬ সালেই জার্মান নারীদের কংগ্রেস থেকে প্রথম প্রস্তাব আসে যে, পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯০৭ সালে স্টুটগার্টে যে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে একই সাথে সমাজতান্ত্রিক নারীদেরও আলাদা একটা কনফারেন্স হওয়া উচিত। এই প্রস্তাবের পর প্রস্তুতি শুরু হয় একটা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারীদের জন্য সম্মেলন আয়োজনের।
১৯০৭: আগস্ট ১৭। ১৫টি দেশের ৫৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে একটা ‘আন্তর্জাতিক উইমেন ব্যুরো’ গঠন করা হয়। যার প্রধান কার্যালয় হয় স্টুটগার্টে এবং ক্লারা জেটকিন সম্পাদিত পত্রিকা Die Gleichheit, যার বাংলা অর্থ “সমতা”, এই পত্রিকাকে এই সংগঠনের মুখপত্র করা হয়। ক্লারা জেটকিন নির্বাচিত হন সংগঠনের সম্পাদক হিসেবে ।
১৯০৮: ৩ মে, আমেরিকার নিউইয়র্কে শিকাগোর গ্যারিক থিয়েটারে প্রায় ১৫০০ নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণে মিটিং অনুষ্ঠিত হয়, যার সভাপতিত্ব করেন লরী এস. ব্রাউন। এই মিটিং এ নারীদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমানাধিকারের দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে দিনটিকে নারীদের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। এইখানে খেয়াল কর সাল ১৯০৮, ১৯০৭ না, তারিখ মে মাসের ৩, মার্চের ৮ তারিখ না এবং জায়গাটা শিকাগো, নিউইয়র্ক না। এটা হলো তোকে খেয়াল রাখতে বলা তৃতীয় পয়েন্ট।
১৯০৯: ২৮ ফেব্রুয়ারি, রোববার। সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার নারী সংগঠন ওম্যান’স ন্যাশনাল কমিটির উদ্যোগে প্রথমবারের মতো সারা দেশে জাতীয় নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটার তাৎপর্য খেয়াল রাখিস। এই দিনটাকে বলতে পারিস আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বপুরুষ।
১৯০৯: ২৪ নভেম্বর ক্লারা লেমলিচের নেতৃত্বে শার্টওয়েস্ট (নারীদের এক ধরনের ব্লাউজ যা শার্টের মতো দেখতে) কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করে। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিলো নারী। ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ধর্মঘট চলে।
১৯১০: ২৬-২৯ আগস্ট। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেন-এ। ১৭ টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এখানেই জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী লুন্ডুসি জিটয্ আমেরিকায় জাতীয় নারী দিবসের ঘটনা থেকে প্রস্তাব করেন যে মে দিবসের মতো করে আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবস পালন করা হোক, ক্লারা জেটকিন এই প্রস্তাবে সমর্থন করেন। নারীদের সমানাধিকার এবং ভোটাধিকারের দাবী সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব পাস হয়। যদিও এই সম্মেলনে নারী দিবস পালন করার কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্বাচন করা হয়নি। মূলত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার থেকে শুরু করে ১লা মে পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে সুবিধামতো দিনে নারী দিবস পালন করা হয়েছে।
১৯১১: কোপেনহেগেন প্রস্তাবের ফলস্বরূপ পরের বছর অর্থাৎ ১৯১১ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। কিন্তু ৮ই মার্চ দিবসটি পালিত হয়নি, এটি পালিত হয়েছিল ১৯ মার্চ, ১৯১১। অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড সহ প্রভৃতি দেশগুলোতে প্রায় ১০ লক্ষ নারী পুরুষ নারী দিবসের মিছিলে অংশগ্রহণ করে। সংগঠিত হয় ৩০০ টিরও বেশি মিছিল। এখানে একটা বিষয় খেয়াল কর- ১৮৭১ সালের ২৮ মার্চ শুরু হয় প্যারী কমিউন যা টিকে ছিলো ২৮ মে, ১৮৭১ পর্যন্ত। ১৯১১ ছিলো এই প্যারী কমিউনের ৪০ বছর। আবার ১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে বিপ্লবের ঢেউ বয়ে গেছে। জার্মানি এবং এর আশপাশের দেশগুলোতে বিপ্লব শুরু হয় ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে। এই বিপ্লবের স্মরণে প্রতি বছর ১৮ মার্চ তারিখে জার্মানীতে পালন করা হয় মার্চের শহীদ দিবস। তোকে যে খেয়াল রাখতে বলেছিলাম এটা হলো তার দ্বিতীয় পয়েন্ট।
১৯১১: ২৫ মার্চ। নিউ ইয়র্ক ট্রায়াঙ্গেল ওয়েস্ট কোম্পানীতে আগুন লেগে ১৪৬ জন যার মধ্যে ১৪৩ জন নারী এবং ৩ জন পুরুষ মারা যায়। বাস্তবে কতজন মারা যায় এখন আর সেটা খুজে বের করা প্রায় অসম্ভব। ধরে নে যে বাস্তবে আরও বেশি মারা গিয়েছে। কারণ এরকম অনিরাপদ কর্ম পরিবেশে যখন দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায় মালিক পক্ষ সবসময় চেষ্টা করে সংখ্যাটা যতটা সম্ভব কমিয়ে দেখাতে। আমাদের দেশেও গার্মেন্টসে দুর্ঘটনায় যখন মানুষ মারা যায় মালিকরা তো বটেই সরকারও কতজন মারা গিয়েছে তা পরিষ্কার ভাবে বলে না। এটা হলো তোকে খেয়াল রাখতে বলা প্রথম পয়েন্ট।
কিরে মাথা ঘুরছে? হঠাৎ কথা থামিয়ে জানতে চায় শাওন।
না না! আপত্তি জানায় সুমন। যদিও আসলেও ঘুম ঘুম আসছিলো কিন্তু এই দিনগুলোর সাথে নারী দিবসের সম্পর্ক আছে তা বোঝা গেলেও কিন্তু ২ রকমের শুরুর গল্পটা কিভাবে আসবে এই নিয়ে একটু একটু আগ্রহও জাগছিল সুমনের।
চল চা খাই। বলে চা বানাতে শুরু করলো শাওন। শাওনদের লাইব্রেরিটা মজার। এখানে চা খাওয়ার জন্য একটা ইলেকট্রিক কেটলি, চা পাতা, চিনি সব রাখা আছে। নিজেরাই বানিয়ে খাওয়া যায়। সুমনেরটায় ৩ চামচ চিনি আর নিজেরটায় কোন চিনি না দিয়ে দুকাপ চা বানিয়ে আবার গল্প বলা শুরু করলো শাওন।
১৯১৪: ৮ মার্চ সারা পৃথিবীতে নারী দিবস পালনের শুরুটা ১৯১৪ সালে। ৮ মার্চ বেছে নেবার কারণ হলো ১৯১৪ সালে দিনটা ছিলো রবিবার। আর বিখ্যাত একটা পোস্টার আছে এই দিনটার। কালো জামা পরা একজন নারী দুহাতে একটা লাল পতাকা নাড়ছে আর পোস্টারে লেখা আছে – “নারী দিবস / মার্চ ৮, ১৯১৪ – নারীদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবীতে এগিয়ে চলুন”। এই দেখ, বলে, সুমনকে একটা পোস্টারের ছবি দেখায় শাওন।
তিন বছর পর আবার নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় ৮ মার্চ । জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৩ ফেব্রুয়ারি, বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অর্থাৎ আমরা এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি সে অনুযায়ী ৮ মার্চ, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার টেক্সটাইল নারী শ্রমিকেরা রুটি এবং শান্তির দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। যা রাশিয়াতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূচনা করে।
অক্টোবর বিপ্লবের পর ( গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে নভেম্বর) এই ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে লেলিন ৮ মার্চ নারী দিবসে হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।
১৯২১: জুন মাসে মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয় 2nd International Communist Women’s Congress এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ক্লারা জেটকিন। এখানে বেলজিয়ামের একজন নারী কমরেড প্রস্তাব করেন যে রাশিয়ান নারীদের বীরত্বের স্মরণে ৮ মার্চ কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে নিয়মিত পালন করা হোক। এবং ১৯২২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে।
কিন্তু… এইখানে একটা বড় কিন্তু আছে… বলে চুপ করে থাকে শাওন ভাইয়া।
– কী সেটা? ধৈর্য্য হারিয়ে তাড়া দেয় সুমন।
– সেটা হলো, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নারী দিবস শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেই পালিত হতো আর অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোই নারী দিবস পালন করতো। এর একটা কারণ ছিলো যে অন্যান্যরা বলছিল যে নারী দিবস তো পালন করা হতো নারীদের ভোটাধিকারের দাবীতে তাহলে ভোটাধিকার যখন পাওয়া গেছে, তারপর নারী দিবস পালন করার আর দরকার কি? কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্তদের বক্তব্য ছিলো যে নারীদের ভোটাধিকার মাত্র একটা দাবী, কিন্তু নারী পুরুষ সমানাধিকারের দাবী, চাকরির ক্ষেত্রে সম মজুরির দাবী, সম্পত্তিতে সমানাধিকারের দাবী এরকম আরও নানান বিষয় আছে যেগুলোর জন্য এখন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। ফলে নারী দিবসের এখনও দরকার আছে এবং তারা ধারাবাহিক ভাবে নারী দিবস পালন করতে থাকে। আবার যারা যারা মনে করে সমাজে সব মানুষের অধিকার সমান হওয়া উচিত – এই অধিকার কোন লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, জাতি ভেদে আলাদা আলাদা হতে পারে না তারা সবাই এই দিবস পালন করে। তারা ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক। বুঝলি?
– শুরুতে যে বলেছিলাম নারী দিবসের প্রোগ্রামে ছেলেরা কেন – তার উত্তর এটা মনে মনে ভাবে সুমন।
– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপ এবং আমেরিকায় পরিবর্তনের ঢেউ আসে, বলে চলে শাওন, মানুষের সমানাধিকারের দাবী যার মধ্যে নারী অধিকারও আছে, তা নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে আন্দোলন নানাদিক থেকে তীব্র হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ পালন করার অংশ হিসেবে ৮ ই মার্চ নারী দিবস পালন করে এবং ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৮ মার্চকে নারী অধিকার এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য জাতি সংঘ দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
– একটু চুপ করে থেকে শাওন বলে, যা তোর গল্প এখানেই শেষ।
– কেমনে কি? লাফ দিয়ে উঠে সুমন। এতক্ষণ ধরে যে ধৈর্য্য ধরে তোমার দিন তারিখ শুনলাম তার আসল কারণ এই নারী দিবসের শুরুর যে দুইটা গল্প আছে সেই গল্পটার জন্য। দাবী সুমনের।
– কিন্তু এখানে তো চলে আসবে আমার নিজের ধারণা, যুক্তি সঙ্গত অনুমান। এর কোন রেফারেন্স বা প্রমাণ দিতে পারবো না। খালি প্রাসঙ্গিক ঘটনাগুলো আলোচনা করতে পারি বড়জোড়। ভুলও তো হতে পারে। আর আরও অনেক অনেক কথা আছে। ধৈর্য্য থাকবে তোর?
– হ্যাঁ হ্যাঁ থাকবে। বারবার ধৈর্য্য নিয়ে প্রশ্নে একটু অধৈর্য্যই হয়ে ওঠে সুমন। বল তো…
– আচ্ছা।
আবারও বলতে শুরু করে শাওন।
– ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে পুরো ইউরোপে সাধারণ মানুষের-শ্রমিকদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। একের পর এক শ্রমিক বিপ্লব ঢেউয়ের মতো বয়ে যায় ইউরোপের উপর দিয়ে। এই বিপ্লবী আন্দোলন এবং এক তত্ত্বায়িত করার প্রক্রিয়ার ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয় কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার। তারপর আবারও শ্রমিক আন্দোলন শ্রমিক বিপ্লবের চেষ্টা এরপর ১৮৭১ সালের প্যারী কমিউন বা আরেকটা ফরাসি বিপ্লব।
– আচ্ছা, আলোচনার মধ্যে হঠাৎ প্রশ্ন করে সুমন, নারী আন্দোলন নিয়ে বলতে গিয়ে তুমি আবার শ্রমিক আন্দোলন শুরু করলা কেন? আর পুরো পৃথিবীতে এত এত দেশ থাকতে সব বিপ্লব ফ্রান্সেই কেন?
– আচ্ছা আরেকদিন তোকে ফরাসী বিপ্লব, প্যারী কমিউন, ১৮৪৮ সালের বিপ্লব এগুলো নিয়ে কথা বলবো। আর নারী আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাব এবং তার গুরুত্ব বোঝানর জন্য ইতিহাস দিয়ে শুরু করলাম আর কি।
– আচ্ছা। ধীরে ধীরে বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে সুমনের কাছে।
– সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে একদিকে সব মানুষের সমানাধিকারের দাবী যেমন আসতে থাকে, তেমনই সমাজের অর্ধেক যে নারী সে নারীদের অধিকার, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এই দাবীগুলোও জোড়াল হয়ে উঠতে থাকে। এই দাবীগুলোতে সারা পৃথিবীতেই নেতৃত্ব দিতে থাকে সমাজতন্ত্রীরা…
– কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা কেন? আর কেউ না কেন? সমস্যাটা কি সমাজতন্ত্রীদের?
– সমস্যা হলো – তুই যখন সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বলবি তখন সমাজের মানুষ হিসেবে তো মেয়েরাও আছে তাদের তো বাদ দিবি না। দিবি কি?
– না, তা কেমনে সম্ভব। বলে সুমন।
– আবার মেয়েদের সমস্যা, সংকট ঠিক সমাজে অন্য সমস্যাগুলোর মতো এক না, একটু আলাদা। ফলে মেয়েদের জন্য আলাদা দাবী, আবার একই সাথে সবার দাবী এইগুলো মিলিয়েই সমাজতন্ত্রীরা বলতো আর কি। এখানে একটা কথা খেয়াল রাখিস – মেয়েদের সমস্যা নিয়ে, মেয়েদের উপর সমাজিক নিপড়ীন নিয়ে সমাজতন্ত্রীদের আগে কেউ বলেনি বা সমাজতন্ত্রী না এমন কেউ বলেনি বা এখনও বলছে না ব্যাপারটা কিন্তু সেটা না। অনেকেই বলেছে – কিন্তু নিজ নিজ অবস্থান থেকে, কেউ কেউ নিজের উপলব্ধি থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছেন, আমাদের এই অঞ্চলে তুই পাবি রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানুষদের, কিন্তু একটা রাজনৈতিক অবস্থান থেকে, একটা আন্দোলনের দাবী আকারে সমাজতন্ত্রীদের আগে আর কেউ করেছে আমার জানা নেই। এমনকি ইউরোপে ১৮ শতক যেটাকে দার্শনিক চিন্তাভাবনার দিক থেকে বলা হয় ‘এইজ অফ এনলাইটেনমেন্ট’ – সে সময়ের অনেক দার্শনিকও নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যুক্তি করেছে, আলোচনা করেছে কিন্তু একটা রাজনৈতিক কর্মসূচী, একটা রাজনৈতিক দাবী এমন আকারে সমাজে কোন ঘটনা ঘটেছে আমার জানা নেই। তুই চাইলে খুঁজে দেখিস।
ব্যাপারটা খুব দারুণ মনে হয় সুমনের। মনে মনে ভাবে- বড় হই – ঠিকই খুঁজে দেখবো। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা কেন রাজনৈতিক দাবী হিসেবে নিতে গেল? অন্যরা কেন এই দাবী করেনি? জানতে চায় সুমন।
– সেটা তো আরেক আলোচনা। কিন্তু এখন না। সব আলোচনা একদিনে শুনতে গেলে একটু পর তোর কান দিয়ে মগজ গলে বের হয়ে আসবে। এখন বরং আগের আলোচনাটা চলুক, সময় পেলে পরে কোন একদিন তোকে সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে গল্প করবো। বলে আগের কথার খেই ধরে শাওন – তো নারী দিবস প্রতিষ্ঠা, এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করা, জনপ্রিয় করা সবগুলো কাজই করেছে সমাজতন্ত্রীরা – কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয় এবং দুটো দেশই নিজেদের প্রভাব তা সামরিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক যাই হোক না বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু নারী দিবস তো সমাজতন্ত্রীদের। পৃথিবীর প্রথম যে দেশ নারী দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে সেটা হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আবার মানুষের মধ্যে এই দিবস পালন করা, এই দিবসকে ঘিরে নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করা তো ক্রমাগত বাড়ছে। তাহলে আমেরিকার ক্রেডিট কমে যায়। ফলে ১৯৫০-৬০ এর দিকে আমেরিকায় নারী দিবসের শুরুর অন্য গল্পটা চালু হয়। ব্যাপারটা এমন যে – ১৮৫৭ সালে অর্থাৎ এমনকি মে দিবসেরও আগে এমন একটা তারিখ এবং ঘটনাকে সাজিয়ে বলা হলো যেখানে প্রমাণ করা গেল নারী দিবসের সাথে সমাজতন্ত্রীদের কোন সম্পর্ক তো নেইই বরং সমাজতন্ত্রীদেরও অনেক আগে থেকেই নারী দিবস পালন শুরু হয়েছে।
একটু থেমে শাওন এবার সুমনকে প্রশ্ন করে।
– তোকে তিনটা বিষয় খেয়াল রাখতে বলেছিলাম মনে আছে?
– হ্যাঁ। সম্মতি জানায় সুমন। অগ্নিকান্ড, দাবী ও মিছিল এবং দিবস পালন।
– হ্যাঁ। তিনটি ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু সময়টা এবং উপলক্ষ্যটা খালি বদলে গেছে। অগ্নিকাণ্ডটা ঘটেছে ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ, ১৮৫৭ সালে না। মিছিলটা ঘটেছে ১৯০৮ সালে, ১৮৫৭ না, আর ১৮৪৮ সালের বিপ্লব ও ১৮৭১ সালের ফরাসী বিপ্লব বার্ষিকী পালন একটা বিষয় হিসেবে এলেও কোন মিছিল বা পুলিশি বর্বরতার ৫০ বছর উপলক্ষে কোন ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ গল্পটা সাজানো হয়েছে সবগুলো সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে। ফলে তুই যদি এখন বলিসও, এসব ঘটনা মানুষের মানতে কষ্ট হবে। কারণ গল্পটা তো সাজানো হয়েছে সত্যি ঘটনার উপর।
– কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচী হিসেবে শুরু হলে, এখন এই যে চামড়া ফর্সা করা কোম্পানির বিজ্ঞাপন, রান্নার মসলার কোম্পানির বিজ্ঞাপন এগুলো হলো কিভাবে?
– এখন যেহেতু সারা পৃথিবীতে নারী দিবস পালন করা হয়, এই দিবসকে নিয়ে আলোচনা হয়, মানুষের মধ্যে আগ্রহের একটা জায়গা আছে ফলে এটাকে নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ ব্যবসায়ীরা ছাড়বে কেন? ফলে যা ছিলো নারীদের অধিকার এবং দাবীর দিন, সেটা এখন আমাদের জন্য হয়ে গেছে ভালোবাসা দিবস আর মা দিবসের জগাখিচুড়ী, সাথে সাথে মেয়েরা যেসব পণ্য ব্যবহার করে তার বিজ্ঞাপন প্রচারের দিনও। বুঝলি?