জীবন সংগ্রামে সমাজ, পরিবারের নানা বাধা কাটিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন দেবহাটার ৫ নারী। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীদের ৫টি ক্যাটাগরিতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় খুঁজেবের করেছে। এসব নারীদের জীবনে রয়েছে আলাদা আলাদা জীবন কাহিনি।

তাদের সেই সংগ্রামের কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হলো: জীবন চলার পথ মসৃণ নয়, আসে নানান বাঁধা-বিপত্তি। সাহসী মানুষ এসব বাধা অতিক্রম করে আত্মপ্রত্যয়ের উপর ভর করে এগিয়ে যায়। সফলতা বয়ে আনে নিজের জীবনে। পাশাপাশি যুক্ত হয় সামাজিক কাজে। অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠে অন্যদের জন্য। এমনই একজন নারী জি.এম স্পর্শ। ১৯৯৩ সালে জেলার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নের শ্বেতপুর গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়। পরে স্বামীর সহযোগিতায় এইচ.এস.সি পাশ করেন তিনি। পরীক্ষার কয়েক মাস পরেই তিনি প্রথম সন্তানের (কন্যা সন্তান) মা হন। যে কারণে অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি পড়া লেখা চালিয়ে যেতে পারেননি। ২০১৯ সালে স্বামী ও পরিবারের সহযোগিতায় জি.এম.স্পর্শ উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর জি.এম.স্পর্শ এর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে উপজেলা গভর্ন্যান্স ডেভালপমেন্ট প্রজেক্ট (ইউজিডিপি) এর সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক নারী উন্নয়ন ফোরাম সংক্রান্ত গাইড লাইনের আলোকে তিনি উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরাম গঠন করেন। একই সাথে নারী উন্নয়ন ফোরামকে টেকসই করার লক্ষে উপপরিচালকের কার্যালয়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা থেকে ফোরামের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। নারী উন্নয়ন ফোরামের মাধ্যমে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত নারী সদস্যদের নিয়ে সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিষদে তাদের ভূমিকা আরও জোরালো করা, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কাজ করা এবং নারী নেতৃত্ব বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ বিষয়ে উজ্জীবিত করছেন/পরামর্শ প্রদান করছেন।

এছাড়া জি.এম.স্পর্শ নারী জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নারী বান্ধব প্রকল্প গ্রহণ ও ফোরামের স্থায়িত্বদানের অংশ হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক ২০১৫ সালের ৩১ মে উপজেলা পরিষদের বাৎসরিক বাজেটের ৩ শতাংশ পর্যন্ত নারীদের জন্য রাখা হয়। উন্নয়ন ফোরামের জন্য বরাদ্দ প্রদান সংক্রান্ত পরিপত্রের আলোকে প্রতিবছর যে বরাদ্দ পেয়ে থাকেন সেটা দিয়ে দেবহাটা উপজেলার সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়/ মাদ্রাসার কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে উঠান বৈঠক, স্কুলে অবহিতকরণ সভা ও নারী জন প্রতিনিধিদের দক্ষতা বিকাশে ব্যায় করছেন। এছাড়া উক্ত বরাদ্দকৃত টাকা থেকে দেবহাটা উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের দুঃস্থ-অসহায় নারী ও শিশুদের চিকিৎসা ও শিক্ষায় ব্যায় করছেন। করোনাকালে নিজস্ব অর্থায়নে দরিদ্র অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া, খাদ্য বিতরণ সহ মানুষ সচেতনতা সৃষ্টি করা। নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা। উপজেলা পরিষদের সম্মানীর টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা সহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অবদান রেখে চলেছেন তিনি।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ফুলজান বিবি। তিনি রত্নেশ্বপুর গ্রামের রায়হান হোসেনের স্ত্রী। প্রায় ২২ বছর পূর্বে তার বিয়ে হয়। সে সময় আমাদের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, তিনবেলা পেট ভরে খাওয়া হত না। পরপর তার দুটি সন্তান হয়। কিন্তু শিশুদের খরচ চালোনোর মত সমার্থ ছিল না তাদের। এক পর্যায়ে খরচ কাটাতে বাড়িতে তখন গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন করা শুরু করেন তিনি। তাতে যে টাকা আয় হত তাতেও সংসার চলত না। তখন সে সেলাই এর কাজ শুরু করে। পরে এনজিও থেকে লোন নিয়ে স্বামীকে ডেকোরেটার এর ব্যবসা ছোট থেকে বড় আকারে রূপ নিতে শুরু করে। এতে করে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। তাদের পূর্বের অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় এখন সমাজের মানুষের কাছে সম্মাননীয় ব্যক্তি হিসাবে সম্মান পায়। বর্তমানে ফুলজান বিবির পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছে।

নির্যাতনে বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন জীবন শুরু করেছেন আরিফা পারভিন। সে জগন্নাথপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের কন্যা। গত ২ বছর আগে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাড়দ্দহা গ্রামে বিয়ে হয় আরিফার। বিয়ের পর থেকে কিছু দিন স্বামীর সংসারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো ছিল। কয়েক মাস যাওয়ার পর তার স্বামী বিভিন্ন নারীর সঙ্গে পরকীয়া জড়িয়ে যায়। এমনকি বিয়ে করা স্ত্রীকে সয্য করতে পারতো না। একসময় কথায় কথায় শারীরিকভাবে নির্যাতন শুরু করে তার স্বামী। অনেক সহ্য করার পরেও যখন তার স্বামীর অভ্যাস পরিবর্তন হয়নি তখন শ্বশুর বাড়ির পরিবারের সকলকে নির্যাতনের বিষয়টি জানান তিনি। জানানোর পরেও তারা তাকে অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটাতে পারিনি। স্বামীর অভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হন, তখন ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির অফিসে অভিযোগ করেন আরিফা। ব্র্যাক অফিসে শালিসের মাধ্যমে মিমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা। এক পর্যায়ে দেনমোহর খোর-পোষ ও ভরপোশন বাবদ মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে তালাক হয়ে যায় তার স্বামী। সে টাকা নিয়ে পানির ফলের ব্যবসা শুরু করেন ওই নারী এবং কিছু জমি বন্ধক ও রেখে সেখানে ফললের চাষ শুরু করেন। পাশিপাশি একটি কারখানার ব্যাগ তৈরীর কাজে যোগ দেন আরিফা। সেখান থেকে সে যে টাকা উপার্জন করে তা দিয়ে নিজের ও পরিবারের আর্থিক খরচ চালাতে সক্ষম হন তিনি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের উপেক্ষা, স্বামীর নির্যাতন, অসহযোগিতা এতকিছুর পরেও থামিয়ে রাখতে পারেনি এই নারীকে। নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা, পরিশ্রম, সততা ও একাগ্রতা তাকে সাফল্যে পৌঁছাতে সহায়ক হয়েছে। সত্যিকার অর্থে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার যে অভিপ্রায়/অদম্য চেষ্টা সেটা অর্জন করেছেন তিনি।

সফল জননী নারী পারভিন আক্তার। তিনি মাঝ-পারুলিয়া গ্রামের আতিয়ার রহমানের স্ত্রী। তিনি জানান, তার স্বামী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীনের পরে তিনি কিছুই করতেন না, স্বামীর তেমন জমি জায়গা ও ছিল না। আমার বিয়ের পর আমাদের ৩ টি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। স্বামী ও ৩টি সন্তান নিয়ে সংসার খুব ভাল চলছিল না। সব-বাধা উপেক্ষা করে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার খরচ কোনভাবে নিজেই চালাতে লাগলাম। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর জন্য বাড়িতে হাঁস মুরগি ও গাভি পালন শুরু করলাম। পালিত পশুপাখি থেকে পাওয়া মাংস ও ডিম ছেলেমেয়েদের চাহিদার পাশাপাশি বিক্রি করা তাদের বই, খাতা, কলম ও পড়া লেখার খরচ যোগাতাম। ছেলে মেয়েরা সবাই ছিল মেধাবী ও পরিশ্রমী । স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সাথে পড়াশোনা করে। বর্তমানে ৩ ছেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সবাই সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। আমার বড় ছেলে তাহাজাত হোসেন (হিরু) সাউথ ইস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট, মেঝ ছেলে শাহাদাত হোসেন (বিরু) মেহেরপুর জেলা আনসার কমান্ডার। ছোট ছেলে ইমদাদ হোসেন (মিথ) ঢাকা পলিটেকনিক কলেজের প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছেলেদের লেখাপড়া সঠিকভাবে চালিয়ে তাদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার দেখা দেখি অন্য নারীরাও তাদের সন্তানদেরকে বিদ্যালয়মুখী করার জন্য আগ্রহী হচ্ছেন ।

শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী তুতিয়া খাতুন। তিনি বটিয়াঘাটা থানার নারায়নখালী গ্রামে ১৯৬৪ সালে মৃত আবুবকর শেখ ও নুরজাহানা বেগমের কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন। ভুতিয়া খাতুন তার জীবন সংগ্রাম নিয়ে জানান, আমার পিতা একজন বিশিষ্ট বস্ত্র ব্যবসায়ী। মাতা ছিলেন একজন গৃহিনী। আমার পিতা তৎকালীন সময়ে ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন, এর পরবর্তী চেয়ারম্যান ছিলেন আমার সেজো কাকা, মেজো কাকা ছিল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমি ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় ভাল ফল অর্জন করে রেখে চলেছিলাম। উপযুক্ত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। সেই থেকে আমার উপর এবং শিক্ষা জীবনের চরম বাধা বিপত্তি। অনেক বাধা বিপত্তি মধ্যে দিয়ে স্বামীর একান্ত প্রচেষ্টায় মেমোরিয়াল সিটি কলেজ খুলনাতে বিজ্ঞান শাখায় ১ম বর্ষে ভর্তি হই। সেখানে থেকে ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হই। সেখানেও আমি বিভিন্ন রিসাইটেশনের সাথে জড়িত থাকি এবং পুরুস্কার প্রাপ্তিও হয়ে থাকি। এমন মুহুর্তে আমার একটি পুত্র সন্তান হয়, তাকে নিয়ে আমি বেশ কষ্টেও লেখাপড়া করি। ১৯৮৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম সম্মান শ্রেণিতে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ভর্তি হয় এবং ১৯৮৬ সালে বি.কম সম্মান ব্যবস্থাপনা বিষয়ের উপর ডিগ্রি লাভ করি। সে সময় আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। এত কষ্ট সত্ত্বেও এবং বিশেষ ত্যাগ তিতিক্ষার পরও আমি ১৯৮৭ সালে এম কম শেষ বর্ষে ভর্তি হয়। সেখান থেকে এম.কম ব্যবস্থাপনা বিষয়ের উপরে ডিগ্রি লাভ করি।

এরপর ১৯৯৩ সালে কলারোয়ার শেখ আমানুল্লাহ ডিগ্রি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হই। আমার স্বামীর বাড়ি দেবহাটার সখিপুর হওয়ায় প্রতিদিন ৭২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আমার কর্মস্থলে যেতে হত। সংসারের সব কাজ শেষ করে সময় মত আমার কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতাম। নির্দিষ্ট কয়েক বছর চাকুরির পরে সহকারী অধ্যাপক পদে উপনীত হই। বর্তমানে ঐ একই কলেজে যথেষ্ট সততা ও কর্মদক্ষতার সাথে (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত আছি। এছাড়া আমার স্বামী কুতুব উদ্দীন বি.এ (ডি.এইচ.এম.এস) হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, ছেলে মেহেদি হাসান বি.এস.সি. এজি (সম্মান) এম.এ.জি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (এলএলবি) অধ্যয়নরত, ছোট পুত্র ডাঃ মাহবুবুল ইমাম এম.বি.বি.এস বি. সি. এস (স্বাস্থ্য) এফ.সি.পি.এস ও এম.এস (কোর্স) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যায়নরত আছে, পুত্রবধু ডাঃ শেরমিন সুলতানা এম.বি.বি.এস, বি.সি.এস (স্বাস্থ্য) গোপালগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্বরত আছেন। বর্তমানে আমি স্বচ্ছল ও স্বাচ্ছন্দময়ী একজন নারী এবং আমার পরিবারের সকল সদস্যবৃন্দ। আমি আমার কর্মস্থলে যথেষ্ট সুনামের সহিত নিয়োজিত আছি।

বার্তাবাজার/এম আই