ঢাকার সাথে হাতিয়ার অন্যতম যাতায়াত মাধ্যম তমরদ্দি-সদরঘাট নৌ-রুট। এ রুটে প্রতিদিন দুটি কোম্পানির ২টি করে লঞ্চ চলাচল করে আসছে। সময়ের সাথে সাথে পণ্য পরিবহন ও যাত্রী সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ায় লঞ্চ সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অথচ লঞ্চের সংখ্যা না বাড়িয়ে তারা রোটেশনের নামে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে ২টি লঞ্চের স্থলে একটি লঞ্চ চালাচ্ছে। এতে করে কেবিন সংকট, ডেকে জায়গা না পাওয়া, অধিক পরিমাণে ভাড়া আদায় করা, ষ্টাফদের অমানবিক আচরণ, খাওয়ার সংকট সহ নানা সমস্যার সম্মূখীন হতে হচ্ছে এ রুটে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীদের। লঞ্চ কর্তৃপক্ষের এমন খামখেয়ালিপনা আচরণে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।

শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সকালে তমরদ্দি লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা থেকে আগত একই পরিবারের ৫জন সদস্য নিয়ে আনছার উদ্দিন নামে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যাক্তি লঞ্চ থেকে নামার সময় চিৎকার শোরগোল করছেন।

সামনে এগিয়ে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকাল থেকে লঞ্চের নাম্বারে কল দিলে বলে আজকে আমরা সিডিউলে নেই, সিডিউলে যে আছে তার নাম্বার দিচ্ছি। পরে কয়েকবার কল দিলে সে নাম্বারটি বন্ধ করে দেয়। বিকেলে সদরঘাটে এসে লঞ্চে উঠার পর কেবিন তো পাইনি, ডেকেও কোন জায়গা না পেয়ে রিভার সাইডের কেবিনের সামনে সবাইকে নিয়ে বসে পড়ি। শেষমেশ সেখানেও বৃষ্টির হানা থেকে বাঁচতে পারিনি। বৃষ্টিতে ভিজে বাচ্ছাদের ঠান্ডা লেগে যায়। রাতের খাবারের জন্য ক্যান্টিনে গেলে খাবার পাইনি। জাহাজের স্টাফদের অসৈজন্যমূলক আচরণ সব যাত্রীদেরকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। তিনি জানান যে, যাত্রী হয়রানির নতুন রূপ ঢাকা-হাতিয়িা নৌ-রুট। এটাই বর্তমান লঞ্চে যাত্রী সেবার মানের চিত্র।

দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় এমভি ফারহান নামের একটি লঞ্চ ও সন্ধ্যা ৬ টায় এমভি তাসরিফ নামের আরেকটি লঞ্চ হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসতো। আবার একই দিন হাতিয়া ঘাট থেকে দুপুর সাড়ে ১২ টায় ফারহান নামের লঞ্চটি ও দুপুর ১ টায় তাসরিফ নামে আরেকটি লঞ্চটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতো। দুই কোম্পানীর দু’টি লঞ্চ উভয় ঘাট থেকে ছাড়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া লাগত এবং প্রতিযোগিতার কারণে যাত্রীরা ভাল সেবা পেত। লঞ্চ মালিকদের অবৈধ সিন্ডিকেটে রোটেশন করে একটি মাত্র লঞ্চ চালু রাখায় বর্তমানে ঢাকা-হাতিয়া রুটের লঞ্চে পা ফেলার জায়গাও পাওয়া যায় না।

জানা যায়, লঞ্চ কোম্পানী দুইটি তথাকথিত রোটেশনের পূর্বে প্রতিদিন দুইটি লঞ্চ উভয় ঘাট থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়লেও পরবর্তী ঘাটে আগে পৌঁছার জন্য প্রতিযোগিতা করতো। ঘাটে আগে নোঙ্গর করাকে কেন্দ্র করে তারা একে অপরের সাথে মারামারিতে লিপ্ত হতো। এ নিয়ে সদরঘাটে কয়েকবার বৈঠক ও হয়েছে। পরে একটি বৈঠকে গত ১০ আগষ্ট থেকে এই রুটে রোটেশন পদ্ধতি চালু করা হয়। রোটেশন পদ্ধতি অনুযায়ী একই দিক থেকে একই কোম্পানীর দু’টি লঞ্চ চলাচল করবে অর্থাৎ যেদিন ফারহান কোম্পানীর দুইটি লঞ্চ ঢাকা ছাড়বে সেদিনই তাসরিফ কোম্পানীর দু’টি লঞ্চ হাতিয়া ঘাট থেকে ছাড়বে। কিন্তু এই নিয়মকেও উপেক্ষা করে উভয় কোম্পানী সমঝোতার মাধ্যমে উভয় ঘাট থেকে দুইটির পরিবর্তে একটি করে লঞ্চ ছাড়ছে।

এতে করে দুই লঞ্চের যাত্রী ও মালামাল একটি লঞ্চে পরিবহন করতে হচ্ছে। অধিক মালামালের কারণে অনেকে ডেকে বসার জায়গা ও পাচ্ছেন না। লঞ্চের সবগুলো কেবিন ভর্তি, ডেকেও প্রচন্ড ভিড় এবং ২য় ও ৩য় তলার সকল অলিগলিতে নারী-পুরুষ বিশৃঙ্খলভাবে শুয়ে আছে। যার ফলে কেবিন ভাড়া করা যাত্রীরা প্রয়োজন মাফিক কেবিন থেকে বের হতে পারছেনা। লঞ্চের স্টাফরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কেবিন ভাড়া দ্বিগুন আদায় করছেন। আবার কর্মচারীদের রুঢ় আচরণ চরম আকার ধারণ করেছে বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ যাত্রীরা।

হাতিয়া দ্বীপ নিউ মার্কেটের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী মো: অলি উদ্দিন জানান, দুইটি লঞ্চের মালামাল বর্তমানে একটি লঞ্চে আনতে হয়। তাতে করে গাদাগাদি করে অনেক মালামালের মধ্যে কাঁচের মালামাল ভেঙ্গে যায়, ফার্ণিচার গুলোতে দাগ পড়ে। যা পরবর্তীতে বিক্রি করতে সমস্যা হয়। দুইটি লঞ্চ সার্ভিসে থাকাকালীন ব্যবসায়ীদের জন্য ভাড়া বিবেচনায় রাখা হত। কিন্তু বর্তমানে একটি মাত্র লঞ্চের কারণে যাত্রীদের চাপে কেবিন সঙ্কট সহ বেশী ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

জার্মান রেডক্রসে কর্মরত মিজানুর রহমান বলেন, ‘ফ্যামিলি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছি। লঞ্চে এসে দেখি কোন কেবিন খালি নেই। এমনকি স্টাফ কেবিনও পাইনি। উপায়ন্তর না দেখে তমরদ্দি বাজার থেকে একটি বিছানা চাদর কিনে এনে দ্বিতীয় তলায় চলাচলের পথের পাশে কোনরকমে বাচ্ছাদের সহ বসার ব্যবস্থা করেছি’।

একই ভাবে সোনাদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রুমানা আকতার নামের গৃহীনি নাতি সহ ঢাকায় ছেলের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে লঞ্চে উঠে দেখেন কোন কেবিন খালি নেই। একটি স্টাফ কেবিন ছিল সেটি ও সীমার বাইরে দাম চাওয়ায় ডেকেই বসে পড়ি। লঞ্চে অনেকবার আসা যাওয়া করলেও এরকমে বিশৃঙ্খল পরিবেশ কখনো সৃষ্টি হয়নি।

হাতিয়া মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, রোটেশনের কারণে যাত্রীদের হয়রানীর মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছে। আগে সিংগেল একটা কেবিন ভাড়া ছিলো ৮শ থেকে এক হাজার টাকা। বর্তমানে ১২শ টাকার নিছে কোন কেবিন ভাড়া নেওয়া হয়না। তারা সিন্ডিকেট করে ষ্টাফদের নামে বুক রেখে কেবিন সংকট দেখায়। পরবর্তীতে ২হাজার টাকার বিনিময়ে কেবিন ভাড়া দেওয়ারও অভিয়োগ করেন তিনি। কেবিনের সামনের জায়গাটাও তারা ম্যাট বিছিয়ে দুইশত টাকা ভাড়া দেয়। তাতে যাত্রীদের কেউ সেখানে রাত্রি যাপন করতে চাইলে ডেকের বর্তমান ৫৫০টাকার ভাড়ার বাইরে জনপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়।

হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাটের ইজারাদার প্রতিনিধি মিরাজ সর্দার জানান, যাত্রীর ভিড় সব সময় বেশী থাকে, লোকসানের কোনও কারণ নেই। বরং প্রতিদিন তারা যাত্রীদেও হয়রানী করে লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করে নিয়ে যায়। যাত্রীদের ভোগান্তি লাগবে রোটেশন পদ্ধতি বাতিল করে পূর্বের ন্যায় প্রতিদিন উভয় ঘাট থেকে দু’টি লঞ্চ চলাচল অব্যাহত রাখার জন্য হাতিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী এবং বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছেন।
এদিকে যাত্রীদের এতো ভিড়ের পরও মালিকদের দাবি, লোকসান সামলাতেই এই রোটেশন পদ্ধতিতে লঞ্চ চালাতে হচ্ছে।

এ সম্পর্কে তাসরিফ লঞ্চের জেনারেল ম্যানাজার কাজী ইকবাল জানান, লোকসান সামলাতেই মূলত এ পদ্ধতিতে লঞ্চ চালানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং যাত্রী সংকট না থাকলে তারা রোটেশন পদ্ধতি তুলে নেবেন।

ফারহান ৪ এর সুপারভাইজার গাজী মোহাম্মদ ফারুক বলেন, বর্ষার সময় যাত্রী কম থাকে। সামনে শীতের সময় আসতেছে, যাত্রী বাড়লে পুরনাই দুটি লঞ্চ চলাচল করবে।
যাত্রীদের সাথে দূর্বেবহরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যাত্রীদের সেবা প্রদানের জন্য, এর বাহিরেও যদি কিছু হয়ে থাকে তা আমার জানা নেই।

এ প্রসঙ্গে মুঠোফেনে আলাপ কালে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জয়নাল আবেদীন জানান, উক্ত বিষয়টি আমরা জেনেছি, লঞ্চ মালিক পক্ষকে আমরা অফিসে ডাকবো। তাদের সাথে বসে এ বিষয়ে শীঘ্রই একটা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

বার্তাবাজার/এম আই