একদিকে তীব্র দাবদাহ, অন্যদিকে মাথার উপর নেই কোন বৈদ্যুতিক পাখা। ছোট্ট কক্ষে শত লোকে গাদাগাদি করে চালিয়ে যাচ্ছেন কাজ। বসার কোন সুব্যবস্থা নেই, তাই হাটু গেড়ে বসে আছেন বারান্দায়। আর সে বারান্দায় মূলব্যান লাগেজ ফেলে রেখে সাড়তে হচ্ছে কাজ। আশ পাশে নেই কোন সুপেয় পানির টিউবওয়েল। তাই তৃষ্ণা নিবারণের ট্যাংকির পানিই ভরসা। তবে তীব্র গরমে সেই পানিও তপ্ত। কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলেও তা চালানো যাচ্ছে না। দেখে বুঝার কোন উপায় নেই যে, এটি একটি আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে সরজমিন গিয়ে দেখা মিলে এমন দৃশ্যের। সেখানে দেখা যায়, নানা সমস্যা ভর করে আছে সম্ভাবনাময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগটিকে। প্রতিদিন এ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে হাজারেরও বেশী ভারত-বাংলাদেশের যাত্রী পারাপার করছে। তবে ইমিগ্রেশনের এমন নাজেহাল অবস্থার কারণে পারাপার করা যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে পৌছেছে। এই বন্দর দিয়ে যাত্রীদের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না
এর সেবার মান। একদিকে ইমিগ্রেশন ভবন অন্যদিকে কাস্টমস ভবন দুই দিকে দু’বার গিয়ে সাড়তে হয় ইমিগ্রেশনের কাজ। এছাড়াও এখানে যাত্রীদের পরিষেবায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। একতলা বিশিষ্ট তিন রুমের ভবনটির দুটি ছোট রুম ও একটি মাঝারি রুম। একটিতে ইমিগ্রেশন ইনচার্জ বসেন আরেকটি হচ্ছে ব্যারাক। মাঝারি কক্ষটিতে চলে অফিসের কার্যক্রম। পুরাতন ভবনটির বিভিন্ন অংশে এর মধ্যে ফাটলও ধরে গেছে।

প্রতিদিন যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গাদাগাদি করেই চলে কার্যক্রম। এর মধ্যে যাত্রীরা তাদের বহনকারী বিভিন্ন মালপত্র বারান্দায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। টিনের একটি ছাউনী থাকলেও সেখানে ২০/২৫ বসার চেয়ার রয়েছে কিন্তু কোন টেবিল নেই। ফরম পূরনের জন্য দেখা গেছে কেউ বারান্দার মেঝেতে বসে আবার কেউ কেউ বিদ্যুৎতের জেনাটারের উপরে কাগজে ফরম পূরণ করছেন। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বিশ্রামের জন্যও জায়গা পাচ্ছে না। কক্ষটিতে এসির ব্যবস্থা থাকলেও যাত্রীর ভীড় থাকায় বাহির পর্যন্ত লম্বা লাইন হচ্ছে। এতে এসিগুলো চালানো সম্ভব হয় না। চলমান তীব্র গরমে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক ফ্যানের ব্যবস্থা না থাকায় গরমের মাঝে শত কষ্ট সহ্য করে ইমিগেশনের কাজ শেষ করছে। তবে বিড়ম্বনা এখানেই শেষ নয়। কাস্টমসের কাজ সাড়তে পাড়ি দিতে হচ্ছে অন্তত আড়াইশ গজ দূরবর্তী অন্য আরেকটি ভবনে। মূলত এক ভবন ও এক ছাতার নিচে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ সাড়তে না পারায় তাদের দুর্ভোগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

ভারত থেকে আগত একজন লক্ষী রানী দাস বলেন, স্বামী ও সন্তান নিয়ে আগরতলা স্থল বন্দর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আখাউড়া স্থল বন্দর হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। যাত্রাকালে আগরতলা ইমিগ্রেশনে সুষ্ঠ ও স্বাচ্ছন্দ্য ভাবে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে এলেও আখাউড়া স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশনে এসে রীতিমত অবাক হলাম। নেই বসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়ালেও ছোট কক্ষটিতে নেই কোন ফ্যানের ব্যবস্থা। হঠাৎ ১২ বছরের বয়সের ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেবা শুশ্রুষা করার জন্য কোন স্থান না পেয়ে ইমিগ্রেশন ভবনের এক কোনায় বসে তার সেবা যত্ন করি। আশে পাশে ছিল না কোন টিউবওয়েল। কপালে যাও ট্যাংকির পানি জুটেছে তাও রৌদ্রের দাপদাহে তপ্ত। তা দিয়েই ছেলেকে সুস্থ করে তোলার কাজ চালিয়ে গেছি। আমি আশা করব বাংলাদেশ সরকার দু,দেশের যাত্রীদের কথা বিবেচনায় এনে ইমিগ্রেশনের স্বার্বিক কার্যক্রমকে আরো উন্নত করবে।

মুক্তি খান নামে এক যাত্রী বলেন, বর্তমানে আখাউড়া ইমিগ্রেশন ভবন নামেমাত্র টিকে আছে। জোড়া তালি দিয়ে সংস্কার করে কোনোমতে, ঝুঁকি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হচ্ছে। কোন মালপত্র সাথে নিয়ে আসলে রাখার জায়গা পাই না। আরেকজনের কাছে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। বছরের কয়েকবার যেতে হয়। স্থায়ী ভবন তৈরি হলে এক ছাতার নিচে সকল পরিষেবা পাওয়া গেলে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের নাগরিকের পাশাপাশি বিদেশিদের আসা যাওয়া আরও বেড়ে যাবে। এবং যাত্রীদের দীর্ঘদিনের দুভোর্গ লাগব হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে চালু হয় আখাউড়া স্থলবন্দের কার্যক্রম। সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান হওয়াই এ বন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট থেকে অনেকেই যাতায়াতে আখাউড়া ইমিগ্রেশন ব্যবহার করছেন।

কাস্টমস সূত্র জানায়, এ ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে প্রতিদিন অত্যন্ত এক হাজার যাত্রী দু,দেশে পারাপার করছে। এর মধ্যে পাঁচশতাধিক যাত্রী ভারতে বর্হিগমন করছেন। যা থেকে প্রতিমাসে ৭৫ লক্ষ টাকা সরকারের আয় হয়ে থাকে। বিগত ছয় মাসে চার কোটি ৫০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এদিকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আখাউড়া চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন আধুনিক ভবন নির্মানের কাজ শুরু হলেও ২০১৭ ও ২০১৯ সালে সীমান্ত আইনের অজুহাতে বিএসেফ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়।

জেলা পুলিশ সুপার মোঃ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশী যাত্রী পারাপার করছে। তবে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সাড়তে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা তা খুবই অপ্রতুল। নতুন ইমিগ্রেশন ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হলে দু,দেশের সেবার মান আরো বৃদ্ধি পাবে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো: শাহগীর আলম বলেন, এ ইমিগ্রেশন দিয়ে দু,দেশের বিপুল সংখ্যাক যাত্রী পারাপার করলেও ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের পর্যাপ্ত সুবিধার কমতি রয়েছে। আমাদের নতুন একটি ইমিগ্রেশন ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল তা বিএসেফের বাঁধায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কথা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেলে আমরা ভবনটির কাজ আবার শুরু করতে পারব।

তিনি আরো বলেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখানে একটি আধুনিক স্থল বন্দর নিমার্ণের উদ্যাগে গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৩.৫৭ একর জায়গা অধিগ্রহণের কাজ হাতে নিয়েছি। আমরা এক দেড় মাসের মধ্যে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। তখন স্থল বন্দর, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম আরো বেগবান হবে। এবং যাত্রীদের পরিষেবা আরো উন্নতি হবে।

বার্তাবাজার/এম আই