‘আসমীনের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দীর ছোট্ট বাড়ী রসুলপুরে যাও’- পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত এই কবিতা আমরা সবাই পড়েছি। কবিতার মতো আসমানী না হলেও কাছাকাছি একজনের সঙ্গে দেখা হলো কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের পশ্চিম পোমকাড়া গ্রামে। নাম নিলুফা আক্তার।

তিনি বলেন, আমাদের থেকে রোহিঙ্গারাও ভালো আছে। আমাদের থাকার জায়গা নেই, খাবারের ব্যবস্থা নেই, অসুস্থ্যতার জন্য কেউ কাজে নেয় না তাই কর্মের সংস্থান নেই, ভিক্ষাবৃত্তিই এক মাত্র সম্বল। স্বামী-পুত্র-কণ্যাসহ ৮ জনের পরিবার নিয়ে যাযাবরের জীবন যাপন করছি। এখন আমার একটি ঠিকানা প্রয়োজন কথাগুলো বললেন অসহায় গৃহকর্তা মো. মামুন মিয়ার স্ত্রী নিলুফা আক্তার।

রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের পোমকাড়া গ্রামের তাজু মুহুরীর পরিত্যাক্ত একটি নির্জন বাড়িতে নিলুফার পরিবারের মানবেতর জীবনযাপনের এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। নির্জন ঝোপঝারের ভেতরে প্রায় ৩০ বছর আগে একটি দোচালা টিনসেট ও একচালা একটি রান্না ঘর রয়েছে। প্রায় ৩ মাস পূর্বে ভিক্ষা করতে এসে এ বাড়িটির
সন্ধান পায়। আশ-পাশে কোন বাড়িঘর নেই, একেবারে একটি ভুতুরে জঙ্গল পোকা- মাকড়, মশা, জোকের উপদ্রপ বেশী থাকলেও এরই মাঝে ৬ শিশু সন্তানসহ এ অস্বাস্থ্যকর বিদ্যুৎবিহীন পরিবেশেই তাদের বসবাস। বাড়ির মালিকের সন্ধ্যা না পেলেও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এখানেই অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তারা। দোচালা টিনের ঘরটির দরজা জানালা নেই, ঘরের বেড়া ভাঙ্গা। রান্না ঘরের চালা থাকলেও বেড়া নেই। রাতের অন্ধকারে কুপি বাতিই ভরসা, মশা এবং জোকের উপদ্রপ থেকে রক্ষায় একটি মশারি কেনারও সামর্থ্য নেই।

নিলুফার স্বামী মামুন জানায়, তার আদী বাড়ি দেবীদ্বার পৌর এলাকার বারেরা গ্রামের আজি উল্যার বাড়ি। তার পিতা মালেক মিয়াও ভূমিহীন ছিলেন। তিনি উপজেলার ধামতী গ্রামের নিলুফাকে বিয়ে করেন। নিলুফা গার্মেন্টেসে চাকরি করত। সে সুবাদে সেও গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে স্ত্রীর সাথে চাকুরি শুরু করেন। লেখাপড়া কম জানায় ভালো বেতন না পেয়ে দেবীদ্বারে চলে আসেন। পৌর এলাকার বানিয়াপাড়া ভাড়া বাসায় থেকে ভ্যান- রিক্সা চালিয়ে জীবীকা নির্বাহ করে আসছিল। একসময় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে ভাড়া বাসায় থাকা সম্ভব হয়নি। বারেরারচর গ্রামের গুচ্ছগ্রামে সুফিয়া বেগমের নামে বরাদ্ধকৃত ঘরে থাকা শুরু করেন। ওখানে প্রায় ১০ বছর থাকেন। সুফিয়া চট্রগ্রামে থাকত, এখন সুফিয়া ফিরে তার ঘর বুঝে নেন। মামুন মিয়া ভিক্ষাবৃত্তির সুবাদে পোমকাড়া গ্রামের এ পরিত্যাক্ত বাড়ির সন্ধান পান। তার জাতীয় পরিচয় পত্র থাকলেও সেটি হারিয়ে ফেলে। তার স্ত্রীর জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকায় মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারের নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এমনকি ৩ পুত্র ও ৩ কণ্যা শিশুর জন্মনিবন্ধনও করাতে পারেননি। বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয় পত্র এবং ভূমিহীন যাযাবর হওয়ায় সন্তানদের নেই কোন শিক্ষার সুযোগ সুবিধা। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কোন কর্মীর সাথে কখনো তাদের সাক্ষাৎ ঘটেনি। বিাবাহের পর ৬ সন্তানের জনক- জননী হয়েছেন তারা।

মামুনের তথ্যানুযায়ী তার সন্তানদের নাম ও বয়সের দিক থেকে জানান, বড় ছেলে আরিফ (১০), বড় মেয়ে শারমিন (৮), মেঝো ছেলে সজিব (৬), মেঝো মেয়ে মাহিমা (৫), ছোট মেয়ে মারিয়া (১৫ মাস) এবং ছোট ছেলে আলী বাবা (১৪ দিন)।

স্থানীয় দুলাল মিয়া বলেন, প্রায় ৩ মাসপূর্বে এ পরিত্যাক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেন মামুনের পরিবার তখন তার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল। এ বাড়ির মালিকের ১১ ছেলে সবাই নামীধামী শিক্ষক, এলাকায় কেউ থাকেন না। বাড়িটি দখলে রাখতে প্রায় ৩০ বছর পূর্বে একটি টিন সেট ঘর ও একটি পাকা ভবন নির্মানাধীন অকস্থায় ফেলে যান। আমরা ছোট বেলায় দিনে এ এলাকায় আসতে ভয় পেতাম। এখনো সেই ঝোপ-ঝার রয়েছে। সাপ, বিচ্ছু, জোঁক, মশা- পোকামাকড়ের মধ্যে ওদের বসবাস। প্রায় দু’সপ্তাহ আগে মামুনের স্ত্রীর ডেলিভারী খরচ ১৪ শত টাকা দিয়ে সহায়তা করি।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. গোলাম সারওয়ার মুকুল ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। এখন আপনাদের মধ্যে শুনেছি। ইউএনওর সাথে আলোচনা হয়েছে তিনি ঘটনা সম্পর্কে জানতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন। আশা করি তার আবাসনসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা হবে।

দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

বার্তাবাজার/এম আই