উপমহাব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান। তিনি সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় তিনি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে বড় অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপরও তাকে কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে মহাব্যবস্থাপক হয়েছেন। শুধু মো. শাহজাহান নন, ২০২০ ও ২০২১ সালে অন্তত ৫৬ কর্মকর্তা অনিয়মে জড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন।

সোনালী ব্যাংকের ওপর গত ডিসেম্বরভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে কর্মকর্তাদের অনিয়মের বিবরণ এবং শাস্তি না পাওয়ার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত দুই বছরে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। তিনি গত বছর অবসরে গেছেন। সম্প্রতি এ বিষয়ে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকে করপোরেট সুশাসন ব্যবস্থা উদ্বেগজনকভাবে ভেঙে পড়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে ন্যূনতম জবাবদিহি না থাকায় ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গুরুতর অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ সুশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

সোনালী ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনের ওপর গত মে মাসে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি বলেন, নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখাসহ বিভিন্ন শাখায় সংঘটিত অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি এবং দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন না মেনে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে গুরুতর অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জুন মাসে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার গ্রাহক রূপসী নিটওয়্যারের রপ্তানি এলসি ১১৬ কোটি টাকার বিপরীতে ১৭৩ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের এপ্রিলে সাড়ে ৭ কোটি টাকার এলসি মূল্যের বিপরীতে ১১ কোটি ১৫ লাখ টাকার ফান্ডেড ঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এ দুই ক্ষেত্রে এলসি মূল্যের যথাক্রমে ১৪৯ এবং ১৪৮ শতাংশ ফান্ডেড ঋণ সুবিধা দিয়ে গ্রাহক যোগসাজশে সরাসরি ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এলসি দুটির বিপরীতে রপ্তানি আয় এলেও গ্রাহকের দায় সমন্বয় না করেই বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রাহকের চলতি হিসাবে জমা করা হয়েছে। যা সরাসরি ব্যাংকের অর্থ লোপাট করার শামিল। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রূপসী ফেব্রিক্স কমপ্লেক্সকে রপ্তানি এলসি মূল্য ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে ৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ফান্ডেড ঋণ সুবিধা দিয়ে শাখা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে গ্রাহককে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ করে দেয়। এসব অনিয়মের সঙ্গে শাখা ব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান, এজিএম মো. সোহরাব, এসপিও আব্দুল আল মরাদ, এসপিও আব্দুল আলীম এবং পিও কামরুল হাসানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও শাখা ব্যবস্থাপক মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি পরবর্তী সময়ে তাকে মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। একই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এজিএম মো. সোহরাব হোসেনকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু ব্যাংকটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান অনিয়মের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া সত্ত্বেও সোনালী ব্যাংকের কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা লঙ্ঘন করে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে সোহরাবের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণীত গাইডলাইন্স অন ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ইন ব্যাংকস এবং সোনালী ব্যাংকের ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স নীতির নির্দেশনা অমান্য করে অডিট কমিটি ও পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাবেক এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান ২০২০ সালে ৩৩ কর্মকর্তা এবং ২০২১ সালে ২৩ কর্মকর্তাকে অনৈতিক সুবিধা দেন। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে অনেক ক্ষেত্রে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কুমিল্লার শ্রীকাইল শাখার অফিসার আব্দুল মজিদ এবং জামালপুরের হাজরাবাড়ী শাখার সিনিয়র অফিসার মো. কাউছার আলমের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ন্যূনতম প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০১৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তার ক্ষেত্রে আলোচ্য গাইডলাইন বা পলিসির নির্দেশনা উপেক্ষা করে তৎকালীন এমডি ও সিইও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতে তা পুনরায় পর্যালোচনা করে বর্তমান কর্তৃপক্ষকে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, নারায়ণগঞ্জ শাখার অনিয়মের ঘটনায় একজনকে সাময়িক বরখস্ত করা হয়েছিল। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যদের বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক যখন পরিদর্শন করেছে, তখন তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। বিষয়টি বর্তমান কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় দেখবে। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। এর আগে তিনি রূপালী ব্যাংকেরও এমডি ছিলেন।

সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত এবং তা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের মতো আরও অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে। নমুনা হিসেবে জয়পুরহাট শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. জাহিদুল হাসানের (বর্তমানে এসপিও) নাম উল্লেখ করা হয়। তিনি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

পর্ষদ সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হবে বা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। তবে কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয় না। সময়সীমা উল্লেখপূর্বক জবাব না দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এলে পর্ষদ অসন্তোষ প্রকাশ করে। একই সঙ্গে আগামীতে এসব ক্ষেত্রে যথাযথ সময়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাগিদ দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান সিইও ও এমডি মো. আফজাল করিম জানান, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর এরই মধ্যেই নারায়ণগঞ্জ শাখার অনিয়মের ঘটনায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যাখা তলব করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের তথ্যের ভিত্তিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাকিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ব্যাংকের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত। প্রয়োজন হলে সোনালী ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে কাঠগড়ায় এনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে পাওয়া অনিয়মের প্রতিকার চাইতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাদের নিজস্ব গবেষণায়ও উঠে এসেছে যে, ব্যাংক খাত বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়ালে তাদের সত্যিকার অর্থে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না, বরং সুরক্ষা দেয়া হয়। এ কারণেই ব্যাংকটির অবস্থা দিন দিন আরও নাজুক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে আসায় এখন আর কারও অস্বীকার করার উপায় নেই। তার মতে, যারা সরাসরি অভিযুক্ত তাদের পাশাপাশি এদের যারা সুরক্ষা দিয়েছেন তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন তিনি। সূত্র: সমকাল

বার্তাবাজার/এম আই