মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা আর গাঁধার গল্পটা মনে আছে? যারা গল্পটা জানেন তারা সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হবেন আজকের এই লেখায়। হোজ্জার গল্পের মতো বলতে হয়, একটা দেশ কিংবা দেশের মানুষ কোন পথে যাচ্ছে সেটা তেমন জরুরী কিছু না। বরং সময়ের পরিক্রমায় পেছনে ফেলে আসা ভুল এবং তার পদচিহ্নগুলো জরুরী। এই দেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একটা বিষয় সবসময় অভিন্ন, সেটা হচ্ছে সতস্ফূর্ত বিপ্লব। এই দেশের মানুষ তখনই বৃহৎ কলেবরে কিছু অর্জন করতে পেরেছে, যখন দলমত নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে এসে বিপ্লবে অংশ নিয়েছে। তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় সংঘটিত বিপ্লবের পরবর্তী দৃশ্যপট সব সময় এতো হতাশা ব্যঞ্জক কেন হয়। এর ব্যাখ্যা দেয়ার মতো আদৌ তেমন কোন উত্তর সদুত্তোর আছে বলে মনে হয় না।

বেশী দূর না, ২৪ এর বিপ্লব এবং এর আদ্যপান্ত বিশ্লেষন নানাজন নানাভাবে করেছেন। আমরা বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকজনকে দেখেছি প্রতক্ষ্যভাবে এর কৃতিত্ব বা অংশিদারিত্ব দখল করতে। হঠাৎ কেউ একজন মাস্টারমাইন্ড নামে আভির্ভূত হচ্ছেন, আবার কেউ অদৃশ্য ত্রাণকর্তার ভূমিকায় তাদের কি কি যোগদান ছিলো, সেগুলোর স্বপ্রভাবিত বিবরণ জানাচ্ছেন। সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এটা অভ্যূথান যে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস, সেটি আলাদা করে কেউ বিবেচনা করছেন না। কেউ ভাবতেই পারছেন না, রাস্তায় থাকা একজন পথচারীও বিপ্লবী অভ্যুথানের সমান হকদার। একজন রিক্সাওয়ালা, একজন বাসের কন্ডাকটার, একজন ফুটপাথের হকার, একজন শ্রমিক মজুর কামলাদারকেও ততটুকু গুরুত্ব দিতে হবে যতটুকু আপনি একজন প্রতিষ্ঠিত নাগরিককে দিচ্ছেন।

বৈষম্যের দল থেকে উন্মুক্ত ছাত্রজনতা অতঃপর জাতীয় নাগরিক কমিটি উত্তোর নাগরিক পার্টি। এতোগুলো প্রক্রিয়াধীন খোলশ বদলে বদলে যে রূপ একটি অভ্যুথান জয়ী দল গঠন করেছে, সেটি আসলে কতটুকু পরিপূর্ন হয়ে উঠতে পেরেছে? জন-নাগরিক বাস্তবতার কতটুকু অংশের মিশেল এই নতুন অস্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছে সেই প্রশ্ন কেউ তুলেছে? নাগরিক ভাবনার কিছু সুবিধাভোগী মানুষ সেইসাথে বিগত দেড় যুগে কুড়িয়ে ফুরিয়ে খাওয়া বিশিষ্টজন আজকের দিনে সবচেয়ে বড় ক্ষমতার স্তর দখল করে হাঁসছে। দাঁতালো কোদাল দিয়ে গণতন্ত্রের মাটি কামড়ে হাঁসছে। যা দেখে পতিত ফ্যাসিস্ট কিংবা তাদের দোসররাও ব্যাঙ্গাত্বক ভাবে বলে উঠছে, তাহলে আমাদের কি দোষ ছিলো? আমরা তো একই নীতিতে অটল ছিলাম।

উপমহাদেশের ইতিহাস পড়ে যারা বড় হয়েছেন তারা সবাই জানেন, যখনই একজন সিরাজ গদিরক্ষায় ঝাপিয়ে পড়েছে, তখনই একজন মীরজাফর তাতে পানি ঢেলেছে। আবার ভূখন্ড পুনরদ্ধারের সময় যখন মীরনেসার তার দূর্গথেকে হামলে পড়েছে, গোলাম মাসুম তথন কর্নেল হার্ডিংএর পাল্লায় পড়ে সান্ধ্যকালীন বিনোদনে বেশী মনযোগী হয়েছেন। এতো সব উদাহরণ টেনে আর মুল কারণ একটাই। একটা বিপ্লব একটা অভ্যুদয় যখন পুরোদেশকে একটা নতুন দিশা উপহার দেয়ার কথা। তখন এর সারবেত্তা বদলে যায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা নবউদ্দ্যোমীদের বেলাল্লাপনায়। সরাসরি কেউ অভিযোগ দিক কিংবা না দিক, এটা তো সত্য যে বর্তমান সরকরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার জন্য যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে, সেভাবেই নীতিভ্রষ্ট হচ্ছে। সরাসরি হোক কিংবা গোপন প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিটি স্তরে এই নোংড়া বিষ পুনরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। সবার কাছেই আছে ফর্দ। ইচ্ছে পুরণের ফর্দ। যেটা পুরণ করতে পারলেই এক অদৃশ্য আলাদীনের জ্বিন বদলে দিচ্ছে জীবনের হিসাব নিকাশ।

পরিশেষে আসছি গাঁধা সংলাপে। যেখানে উল্টো মুখ করে বসে আছেন শাসকের পান্ডারা। পেছনে পেছনে ভ্যান্নারা বাজিয়ে এগিয়ে চলছে একদল বুদ্ধিজীবির সেই সাথে উৎকট চিৎকার করা কিছু চরিত্র। ফেলে আসা অতীতের কুশিলবদের বাঁচাতে কিংবা তাদের পরম্পরা রক্ষা করতে যে শাষন ব্যবস্থা চলছে, এটা চলমান থাকা না থাকার মধ্যে আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই। প্রতিমূহুর্তে বক্তব্য বদলে যাচ্ছে, চেহারা থেকে মুখোশ খুলে আসছে, কথা বলতে শুরু করলে অতীতের দূর্গন্ধ ভেসে আছে বাক্যদিয়ে। এমন নির্ধারক কি আদৌ চেয়েছিলো মুক্তিকামী সাধারণ জনগন? নাকি প্রতিবারের মতো এবারো বলতে হবে, নাদের আলী পদ্মবিল দেখাতে ঠিক নিয়ে যাবে তবে বড় হতে কত শতাব্দির প্রয়োজন সেটা আমি কিংবা নাদের আলীদের কেউেই জানে না।

লেখক, সম্পাদক ও প্রকাশক
নাছির উদ্দিন পাটোয়ারী