তীব্র গরমে সারাদেশ ওষ্ঠাগত। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু লবণ উৎপাদনে। গরমের তীব্রতা বাড়লে বাড়ে লবণ উৎপাদন। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত লবণ চাষীরা। সারা দেশের মানুষ অসহ্য দাবদাহ থেকে বাঁচতে যখন বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রার্থনা করে, ঠিক তখনই হচ্ছে লবণ উৎপাদনের জন্য আদর্শ সময়।

টানা কয়েক দিনের দাবদাহে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে। তীব্র গরমে বিভিন্ন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হলেও দৈনিক লবণ উৎপাদন হচ্ছে অন্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ কক্সবাজার জেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে দৈনিক রেকর্ড ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এতে মহাখুশি উপকূলের ৪৫-৫০ হাজার প্রান্তিক লবণচাষি।

চাষিরা বলছেন, পুরো বৈশাখ মাস এমন অবস্থা বিরাজ করলে লবণের বাম্পার ফলন হবে। চলতি মৌসুমে বিগত চার মাসে উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশি। সব মিলিয়ে চলতি মাস পর্যন্ত সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন লবণের বার্ষিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। অবশ্য চাষীরা বলছেন, এর মধ্যে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সাইক্লোন, কালবৈশাখীর তাণ্ডব কিংবা ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে। একদিন বৃষ্টি হলে প্রায় এক সপ্তাহ লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। তখন সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৫ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন।

আবহাওয়া অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তখন লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হবে।

কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাজার হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। চাষিরা মাঠের ওপর কালো ত্রিপল বিছিয়ে সমুদ্রের লোনাপানি জমিয়ে রাখছেন। তপ্ত রোদে শুকিয়ে সেই লোনাপানি লবণে পরিণত হচ্ছে। কিছু চাষি মাঠে উৎপাদিত লবণ গর্তে ঢুকিয়ে (মজুত) রাখছেন। কেউ কেউ বস্তায় ভরে লবণ বাড়ির আঙিনায় স্তূপ করে রাখছেন। কেউ গুদামে মজুত করছেন।

বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, গত মৌসুমে এ সময়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল। এবার তীব্র দাবদাহের ফলে টানা তিনদিন ধরে দৈনিক ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মৌসুমের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন।

বিসিক লবণ প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪১০-৪২০ টাকায়। গড়ে ৪০০ টাকা ধরলে দৈনিক উৎপাদিত ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টন লবণের দাম আসে ৩৫-৪০ কোটি টাকা।

লবণ শিল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভূইঁয়া বলেন, আগামী ১৫ মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন করা যাবে। প্রতিবছর এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কালবৈশাখী ও বৃষ্টি দেখা দেয়। এতে সাত-আট দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। এবারও তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

লবণ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২ এপ্রিলের ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে টানা সাতদিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল। ১০ এপ্রিল থেকে পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। এর আগে ২০ মার্চের ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিতে সাতদিন লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।

পিএমখালীর চাষি হাসান বলেন, কয়েক দিন ধরে মাঠে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এতেও মনে শান্তি নেই। কারণ, আবহাওয়া অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তখন লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

খুরুশকুলের চাষি গফুর আলম বলেন, ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদনের খরচ বাড়ে। কিন্তু সেই হিসেবে লবণের দাম বাড়ে না। বর্তমানে মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪১০-৪২০ টকায়। মণপ্রতি লবণ উৎপাদন, শ্রমিক ও পরিবহনের বিপরীতে খরচ যায় ২৮০ টাকার বেশি।

কক্সবাজার লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী জানান, সিন্ডিকেট করে লবণের দাম একেক সময় একেক রকম নির্ধারণ করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চাষিরা প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেন ২৫০-৩০০ টাকায়, মার্চে ৩২০-৩৭০ টাকায়, আর এখন ৪১০-৪২০ টাকা। চাষিদের দাবি ছিল মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লবণ আমদানি বন্ধ রেখে মাঠপর্যায়ে চাষিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রিও হয়েছিল। পরবর্তীকালে সিন্ডিকেট চক্র দাম সর্বনিম্ন ২৫০ টাকায় কমিয়ে আনেন।