ইতালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখিকা উরিয়ানা ফালাচি ১৯৭০-এর দশকে বিশ্বের নানা খ্যাতিমান ও বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচনায় আসেন। তার বিখ্যাত বই “Interview with History”–তে তিনি স্থান দিয়েছেন ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের, যার মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো।

শেখ মুজিবের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারটি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্বস্তিকর। সাক্ষাৎকার অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি একপ্রকার পালিয়ে এসেছিলেন। কথোপকথনে উঠে আসে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, আবেগ, এবং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা। সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ফালাচি লেখেন, “১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর হাতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে আমি সিদ্ধান্ত নিই, আর কখনও ঢাকায় ফিরব না। কিন্তু সম্পাদক চাইলেন, আমি যেন শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার নেই। কারণ, পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আবার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছেন।”

ঢাকায় পৌঁছে তিনি মুজিবের সাবেক অনুবাদক ‘মিস্টার সরকার’-এর সহায়তায় সরাসরি ধানমন্ডির বাড়িতে যান। সেখানে রান্নাঘরে দেখা মেলে পরিবারের সদস্যদের, যাঁরা মাটির গামলায় ভাত খাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় রান্নাঘরের দরজায় দেখা যায় তাঁকে—সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক রোমান বীরের মতো চেহারা। ফালাচি লেখেন, “যদিও তার বয়স ৫১, তিনি ছিলেন সুদর্শন, দৃঢ় স্বাস্থ্যের অধিকারী। মুখাবয়ব ছিল তীক্ষ্ণ ও কর্ণগ্রাহী। কিন্তু ব্যবহার ছিল অবজ্ঞাসূচক।”

সাক্ষাৎকারের দিন তাঁকে দীর্ঘ চার ঘণ্টা একটি করিডরে বসিয়ে রাখা হয়, যেখানে প্রায় ৫০ জন অপেক্ষমাণ ছিলেন। রাত সাড়ে আটটায় কক্ষে ডাকা হয়। সেখানে প্রবেশ করেই ফালাচি লক্ষ্য করেন, তিনি বসে আছেন বিশাল সোফার মাঝখানে, দুই পাশে মন্ত্রীরা। কেউ স্বাগত জানাননি। সাক্ষাৎকার শুরু হতেই তিনি বলেন, “পাকিস্তানিরা ৩০ লক্ষ লোক হত্যা করেছে। আমার নারীদের হত্যা করেছে তাদের স্বামী ও সন্তানের সামনে।”

ফালাচি শান্তভাবে প্রশ্ন করতেই তিনি চিৎকার করে বলেন, “তোমার কিছু জানার অধিকার নেই।” ফালাচি জানতে চেয়েছিলেন, পাকিস্তানে তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল কিনা। তিনি জানান, “না, তারা জানতো সেটা কাজে আসবে না। তারা আমার সাহস ও শক্তি জানতো।” কবর খোঁড়ার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “১৫ ডিসেম্বর আমার সেলে কবর খোঁড়া হয়েছিল।” এক জেলা প্রশাসক তাকে পালাতে সহায়তা করেন। ভুট্টো প্রসঙ্গে বলেন, রাওয়ালপিন্ডিতে ব্যক্তিগত প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভুট্টো। তবে তিনি জানিয়ে দেন, জনগণের সম্মতি ছাড়া তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।

সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত আসে যখন ফালাচি প্রশ্ন করেন, ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর হাতে বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তাঁর মতামত কী। তিনি জোরে বলেন, “তুমি মিথ্যা বলছো, কিছুই ঘটেনি।” ফালাচি পাল্টা বলেন, “আমি নিজ চোখে দেখেছি।” উত্তরে তিনি বারবার ফালাচিকে “মিথ্যাবাদী” বলেন।

এক পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে, তিনি সত্যিই সমাজতন্ত্রী কিনা। তিনি বলেন, “হ্যাঁ”, কিন্তু তার ব্যাখ্যায় অস্পষ্টতা ছিল। এই সাক্ষাৎকার ছিল ফালাচির জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। তিনি লিখেছেন, “সাক্ষাৎকার শেষে মনে হচ্ছিল, এই মানুষটি ভয়, চাপ ও মানসিক ক্লান্তিতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।”

 

বার্তাবাজার/এসএইচ