জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে ৯ জন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট। গত ১৭ মার্চ এক বিশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সিদ্ধান্তের প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও উক্ত শিক্ষকদের বরখাস্তের কোনো নোটিশ জারি কিংবা চিঠি প্রদান করা হয়নি। ফলে অভিযুক্ত শিক্ষকদের এখনও সুযোগ রয়েছে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের। এতে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের ফলাফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের উপর হামলায় মদদের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক শফিক-উর-রহমান ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবউননেছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তারা নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

সাময়িক বরখাস্ত শিক্ষকরা হলেন- সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, সাবেক প্রক্টর ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর কবির, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের (বর্তমান ১০ নং ছাত্র হল) তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ইস্রাফিল আহমেদ রঙ্গন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী ইকবাল, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শেখ হাসিনা হলের (বর্তমান ১৩ নং ছাত্রী হল) তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ হোসনে আরা, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ নাজমুল হোসেন তালুকদার এবং পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার।

জানা যায়, জুলাই হামলায় মদদ দেয়ার অভিযোগে উক্ত শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। তবে তাদের বরখাস্তের অফিস আদেশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। বরখাস্ত হওয়া এসব শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক হোসনে আরা সম্প্রতি একটি ব্যাচের ফলাফল প্রস্তুত কমিটিতে কাজ করছেন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মেহেদী ইকবালকে একটি ব্যাচের ফিল্ড ট্যুরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্লাসে ফিরতে সম্প্রতি বিভাগের সাবেক-বর্তমান কিছু শিক্ষার্থীদের দিয়ে বরখাস্তের প্রতিবাদে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার আন্দোলনের চেষ্টা করিয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া সম্প্রতি বিদেশে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ছুটি চেয়েছেন সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ। তবে এ ছুটি মঞ্জুর করেনি কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও কয়েকজন শিক্ষক শাস্তি মওকুফের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তদবিরের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছে বেশ কয়েকটি সূত্র।

এদিকে, বরখাস্তের সিদ্ধান্তের এক মাস পেরিয়ে গেলেও অফিস আদেশ জারি না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষক ক্লাস-পরীক্ষা নিলে ফলাফল বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করছেন তারা। এছাড়া সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক শফিক উর রহমান ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবউননেছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তার সমালোচনাও করেছেন তারা।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি সিন্ডিকেট মিটিংয়ের এক মাস পেরিয়ে গেলেও বরখাস্তের কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। আমরা মনে করছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলেই এখনও কোনো লিখিত আদেশ জারি করে নাই। আমরা চাই দ্রুত এ সিদ্ধান্ত যেন জারি করা হয়। এছাড়াও আমরা মনে করি এ হামলায় জড়িত শিক্ষকরা যদি বহাল তবিয়তে থাকে তাহলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পরবে।

গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আবদুর রশিদ জিতু বলেন, আমরা প্রশাসনকে বারবার অফিস আদেশ দেওয়ার বিষয়ে বলেছি। হামলার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে যদি শুধু দায়সারা ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে জুলাই আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংশয় থেকেই যাবে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিচারের প্রশ্নে আমরা কোন ছাড় দেব না। এমনকি, যদি কোনো শিক্ষক হামলাকারী শিক্ষকদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তাকেও আমরা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করব।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, হামলায় মদতদাতাদের ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার নৈতিক ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করিনা। তাদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের ফলাফল জালিয়াতিও অসম্ভব কিছু নয়। লাশের উপর দিয়ে বিপ্লব হলো, বিপ্লবের ফসল এই প্রশাসন এখনো অপরাধীদের দৃশ্যমান বিচার করতে পারেনি। এটা দুঃখজনক। একমাসেও কোন আদেশ জারি করা হয়নি, এখানে প্রশাসনের ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়।

অফিস আদেশ জারি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এ বি এম আজিজুর রহমান বলেন, সিন্ডিকেট সভার বহিষ্কারাদেশের নথি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলেই তা কার্যকর হবে।

কবে নাগাদ অনুমোদন দেওয়া হবে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, খুব দ্রুতই হবে। এমনকি প্রতিদিন আমি এই আশায় থাকি যে আজকেই অনুমোদন আসবে। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কার কাছে নথিটি আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্ভবত উপাচার্য মহোদয়ের নিকটে আছে।

 

বার্তাবাজার/এসএইচ