ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ওসি রওশন আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় সমান অভিযোগ উঠেছে। কোনো অপরাধ ছাড়াই গ্রেপ্তার করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে সাধারণ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো, সংঘর্ষে আহতদের মামলা না নেওয়ার ও ফসলি জমি কাটায় জব্দকৃত ট্রাক্টর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ওসির এসব অনিয়মে অতিষ্ট বিজয়নগরের সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় লোকজন ও ভূক্তভোগীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিজয়নগরের চান্দুরা থেকে নারায়নগঞ্জের বন্দর এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন ও তার ভগ্নিপতি মো. সালমানসহ চারজনকে আটক করে বিজয়নগর থানার ওসি। এক লাখ ৫ হাজার টাকা রেখে মারধর করে তাদেরকে ১৫১ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১৫ রমজানের দিন উপজেলার ভিটিদাউদপুর গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় রত্ম আক্তারের ভাই সোহরাব মিয়ার শরীরে শতাধিক ও ভাতিজার পিঠে ৩০টি সেলাই লাগলেও মামলা নেননি ওসি। নিয়েছেন প্রতিপক্ষের মামলা।
২৩-২৪ বছর সৌদিআরবে কাটিয়ে গত দেড় থেকে দুই বছর আগে একেবারে দেশে চলে আসেন উপজেলার খাদুরাইল গ্রামের জয়নাল আবেদীন মুন্সী (৪৮)। গত ৩ এপ্রিল দিবাগত মধ্যরাতে উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবদলের সাবেক সদস্য সচিব থেকে বহিস্কৃত মোখলেছুর রহমান ওরফে লিটন মুন্সী, এলাকার কেবলা কাসেম ও মির্জাপুরের মো. হানিফ বাড়িতে গিয়ে জয়নালকে ডেকে পুলিশে ধরিয়ে দেন।
গত ফেব্ররুয়ারি মাসের শেষের দিকে মধ্যরাতে উপজেলার হরষপুর থেকে দুটি ট্রাক্টর জব্দসহ দুইজনকে আটক করে এক লাখ টাকা পেয়ে এবং দ্বিতীয় দফায় তিনটি ট্রাক্টর জব্দসহ তিনজনকে আটক করে ৬৭ হাজার টাকা পেয়ে ছেড়ে দেন ওসি। নারায়নগঞ্জের বন্দর এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, চাচাতো ভগ্নিপতি মো. সালমানকে সৌদিআরবে পাঠানোর বিষয়ে কথা বলতে বিজয়নগরের চান্দুরার কাঠমিস্ত্রি ও ফার্নিচার ব্যবসায়ী সালাম মিয়ার কাছে যাই। ভগ্নিপতি, এক বন্ধু ও চাচী সঙ্গে ছিল। কথাবার্তা চূড়ান্ত হলে টাকা দিবে ভেবে সঙ্গে এক লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। কথাবার্তা চূড়ান্ত না হওয়ায় ফেরার পথে চান্দুরা বিজয়নগর থানার ওসি সঙ্গে তিন-চারজনকে নিয়ে আমাদের গাড়ি থামান। তল্লাশী চালালে চাচীর কাছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা পান। ভগ্নিপতিকে পুলিশের গাড়িতে তুলে চর-থাপ্পর মারেন ওসি। থানায় নিয়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ, হাত ও পা বেঁধে ওসিসহ তিনজন আমাকে এ ঘন্টা পেটান। সঙ্গে থাকা ভগ্নিপতি ও এক বন্ধুকেও মারধর করা হয়। ওসি বার বার বলছিলেন আমরা মাদক নিতে এসেছি। ব্যবসা করি তথ্য প্রমাণ দিলেও ওসি শুনেননি। সকলের মুঠোফোন ও সব টাকা রেখে পরদিন ৯ এপ্রিল আমাদের ১৫১ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠান। ওইদিনই জামিন পেয়ে থানায় গেলে মুঠোফোনগুলো ফেরত দেয় পুলিশ। আর এক লাখ ১০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন মর্মে একটি ভিডিও করেন ওসি। ভিডিও বন্ধ করে তিনি মাত্র ৫ হাজার টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকা রেখে দেন। বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দেন ওসি।
উপজেলার খাদুরাইল গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদন মুন্সীর স্ত্রী সাবিনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী ২৩-২৪ বছর প্রবাসে ছিল। সারা শরীর জুড়ে এলার্জি ধরা পড়লে অসুস্থতার জন্য দেড় থেকে দুই বছর আগে দেশে চলে আসে। দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। বাড়িতেই থাকত। কোনো রাজনীতি করত না। গত ৪ এপ্রিল ভোররাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) তিনটার দিকে আমার স্বামী ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। উপজেলার কয়েকজন বাড়িতে এসে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে পুলিশের কাছে দিয়ে দেন। বিনা অন্যায়ে আমার স্বামীকে তারা ধরে নিয়ে গেছে। তারা টাকা দিয়ে আমার স্বামীকে ধরাই দিছে। রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় স্বামী এখন কারাগারে।
মোখলেছুর রহমান ওরফে লিটন মুন্সী বলেন, তিনি রিয়াদস্থ বিজয়গর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পর্কে আমার চাচাতো ভাই। এই অভিযোগ সত্য নয়।উপজেলার সাতগাঁও উত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহীন মিয়া বলেন, ঈদের দিন সকালে বাড়ির উঠানে ফেলে পূর্ববিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের সাতজন লোক আমাকে মারধর করে। মাথায় দা দিয়ে কুপিয়েছে। মাথায় চারটি সেলাই ও মুখের মাড়িতে তিনটি সেলাই লেগেছে। এঘটনায় থানায় অভিযোগ দিলেও তা মামলা হিসেবে নথিভূক্ত হয়নি। সুষ্ঠু বিচার পাব বলে থানায় দারস্থ হলেও বিচার পায়নি।
ভিটিদাউদপুর গ্রামের রত্না আক্তার বলেন, বিদ্যুতের সংযোগ না দেওয়ায় গ্রামের জামাল মিয়ার পক্ষের লোকজনের হামলায় আমরা সাতজন আহত হয়েছি। ভাই সোহরাব মিয়ার দুই হাতের কব্জি থেকে কাধের জোড়া পর্যন্ত ও বুকের মধ্যে ছুরিকাঘাত করা হয়। তার দুই হাতের রগ কাটা পড়েছে। দুই হাতে ৫০টি করে সেলাই লেগেছে। হাতে এখনো বশ আসেনি। ছুরিকাঘাতে ভাতিজা রিপন মিয়ার পিঠে মেরুদন্ড বরাবর অংশে ৩০টি সেলাই লেগেছে। তিনি বলেন, ঘটনার দ্বিতীয় দিন থানায় গিয়েছি কিন্তু ওসি প্রতিপক্ষের মিথ্যা মামলা নিয়েছে। পাঁচদিন থানায় গেলেও আমাদের মামলা নেয়নি। জানতে চাইলে ওসি বলেন, মামলা নিব না, বেশি কথা বলবা না। ওসি আমার দিকে একটু তাকিয়েও দেখেননি। থানায় গিয়া বুঝেছি নিরহের পক্ষে কেউই নাই। প্রতিপক্ষের লোকজন নিশ্চয় কিছু করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, ফেব্ররুয়ারি মাসের শেষে দিকে একদিন রাতে ওসি রওশন আলী একটি মাইক্রোবাসে ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভেকুর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। ঘটনাস্থল থেকে দুইজনকে আটকসহ দুটি ট্রাক্টর জব্দ করে থানায় নিয়ে যান। মধ্যরাত চারটায় ওসিকে এক লাখ টাকা দিয়ে দুটি ট্রাক্টর ও দুই জন লোককে ছাড়িয়ে আনি। পরে রমজান শুরুর কয়েকদিন পর ওসি আবার তিনটি ট্রাক্টর জব্দসহ তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যান ওসি। পরে প্রথম দফায় ৬২ হাজার ও দ্বিতীয় দফায় ৫ হাজার টাকা দিয়ে এসব ছাড়িয়ে আনি।
বিজয়নগর উপজেলার বুধন্তী ইউনিয়নের খাবিবুর রহমান মনির ও চান্দুরা ইউনিয়নের সাতগাঁ গ্রামের মিলন মৃধা ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে লিখেন, বিজয়নগর থানার ওসি রওশন আলীকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হোক অন্যথায় যেকোন অন্যাকাঙ্খিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে উপজেলা বাসীর। তিনি আরো লিখেন, ওনার (ওসির) বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ইতিমধ্যে উপজেলাবাসীর মুখে মুখে উঠে গেছে। ওনার (ওসির) বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ও জেলা পুলিশ সুপার এসপি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এই দুইজন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের আইনজীবী নাসির মিয়া বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ও পিআরবি আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ যদি ওসির কাছে জানানো হয়, ওসি মামলা নথিভূক্ত করতে বাধ্য। যদি মামলা নথিভূক্ত না করে তাহলে পুলিশকে নোট দিতে হবে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিজয়নগর থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) রওশন আলী বলেন, প্রবাসী সৌদিআরবের রিয়াদের আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার একাধিক ছবি আমাদের কাছে রয়েছে। সেজন্যই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি অভিযোগগুলো সত্য নয়, অনেক ঘটনা আমার মনেও নেই। স্বার্থের হানী ঘটলে মানুষ কত অভিযোগই করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপার এহতেশামুল হক বলেন, পুলিশের কেউ যদি কোনো অপরাধ বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। নারায়নগঞ্জের ভূক্তভোগীরা অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম পুলিশ রেঞ্জের ডিআইজি মো: আহসান হাবীব পলাশ বলেন, আমি বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো।
বার্তাবাজার/এসএইচ