‘ইশকুলেও যাই নাই, পড়ালেহাও করি নাই। করমু ক্যামনে? ছোডকালে ভাইরে রাকতাম। মায় কামে যাইত। আর এহন নিজেই গার্মিসে কাম করি।’

রাজধানীর হাজারীবাগ বস্তির ১৫ বছরের সীমা এভাবেই তার বিদ্যালয়ে না যাওয়ার গল্প বলছিল। পোশাকশ্রমিক সীমা কখনো স্কুলে যায়নি। সীমার মা সুমি বেগম বললেন, ‘গরিবে চাইলেও পড়ান যায় না। হাজারডা অসুবিদা থাহে।’

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বস্তিতে পরিবেশগত কারণে শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে প্রি-প্রাইমারি স্কুল পরিচালিত হলেও সেখানে শিশুদের নিয়মিত উপস্থিতি কম। যাদের পড়ালেখা মূলত প্রাথমিকের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। স্কুলে যাওয়ার দিক দিয়ে ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুরা এগিয়ে।

সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগ বস্তি, কমলাপুর রেললাইন বস্তি, মোহাম্মদপুর বরকতের বস্তি, বেড়িবাঁধ মাস্টারের বস্তি, আগারগাঁও করিমের বস্তি, কুমিল্লা বস্তি, বিএনপি বস্তি, কড়াইলে রাজ্জাকের বস্তি, বেলতলা বস্তি ও গোডাউন বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, বস্তিতে মেয়ে শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা। এর মধ্যে অভিভাবকদের অভাব অনটন মেয়েশিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

জীবন ও জীবিকার তাগিদে অনেক মেয়েশিশুই স্কুলে যেতে পারে না কিংবা ঝরে পড়ে। বস্তিতে ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুরা কম বয়সে উপার্জন শুরু করে। একটু বড় হলেই বাসায় গৃহকর্মীর কাজে লেগে যায়। বয়স ১২-১৩ হলেই পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বস্তিতে অভিভাবকেরা সন্তানের ওপর বেশিমাত্রায় আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকেন। রাষ্ট্র যদি এসব শিশুর জন্য মাসিক বৃত্তি ও খাবার নিশ্চিত করতে পারে, তবে ঝরে পড়া অনেকটা কমানো সম্ভব হবে। এতে স্কুলগামী শিশুর সংখ্যাও বাড়বে।

বস্তিতে মেয়েশিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। যেহেতু, বস্তিতে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়, সে ক্ষেত্রে চাইলেও তারা পড়ালেখা করতে পারে না। এখানকার অভিভাবকদের ধারণা, মেয়েরা বিয়ে হলে অন্যের ঘরে চলে যায়। তাহলে তাদের পেছনে খরচ করে পড়াশোনা করিয়ে লাভ কী?

আগারগাঁওয়ের করিমের বস্তি ও কুমিল্লা বস্তিতে দেখা গেছে, এখানকার শিশুরা শেরেবাংলা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলোক শিশু শিক্ষালয় ও শেরেবাংলা নগর শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে লেখাপড়া করে। তবে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকেরা শিশুদের পড়া বুঝিয়ে দেন না। উপরন্তু খারাপ ব্যবহার করেন বা মারধর করেন। এছাড়াও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। বিভিন্ন অজুহাতে তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেন, যা গরিব মা-বাবাকে অনেক সময় সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরুৎসাহিত করে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একমত পোষণ করে শেরেবাংলা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষকদের মধ্যে অনেকের গরিব বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি অবহেলা করার প্রবণতা থাকে। এ কারণে তাদের পড়া বুঝিয়ে দেওয়া বা শেখানোতে আগ্রহ থাকে না। এছাড়াও আমাদের সারাদিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, যার কারণে অনেক সময় শিশুদের প্রতি খেয়াল করা সম্ভব হয় না।’

এখানকার অভিভাবকদের মতে, পড়ালেখা একবার বন্ধ হলে আর শুরু হয় না। আবার বস্তির পরিবেশও পড়ালেখাবান্ধব নয়। অনেকে মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করলেও তারা যায় না। গেলেও নানা অজুহাতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পড়ালেখার প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ নেই। মোহাম্মদপুর বরকতের বস্তির কামাল বলেন, ‘মাইয়ারে ডেইলি পিডাইছি, তা-ও ইশকুলে যায় নাই।’

তবে কড়াইল রাজ্জাকের বস্তি, বেলতলা বস্তি ও গোডাউন বস্তির পড়ালেখার চিত্র অন্যান্য বস্তি থেকে অনেকটা ভালো। এখানকার প্রায় সব মেয়েশিশুই স্কুলে যায়। কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না। পঞ্চম শ্রেণি পাশের আগেই তাদের পড়া বন্ধ হয়ে যায়।

এসব বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, বস্তির অভিভাকেকেরা পড়ালেখার প্রয়োজনীতা সম্পর্কে জানে। কিন্তু নানা কারণে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেন না বা সন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন না।

এ বিষয়ে বেড়িবাঁধ মাস্টারের বস্তির স্বপ্নীল শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক মামুন রহমান বলেন, এখানে মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো হয়। নানা সমস্যার কারণে এদের পড়ালেখা হয় না। কিন্তু প্রত্যেক মা-বাবাই চান, তার সন্তানটি পড়ালেখা করুক। সরকারসহ অনেক এনজিও শিশুদের শিক্ষার জন্য নানা কর্মসূচি চালু করেছে। তবে বস্তির শিশুদের তুলনায় প্রয়োজনীয় স্কুল বা শিক্ষক কোনোটাই নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না হতেই অনেকে শিশু শ্রমিক হয়ে যাচ্ছে।

বার্তাবাজার/এম আই