আইসিটি ডিভিশনের অধীনস্থ বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত “এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিইজি)” প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটি দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনী কাজের জন্য হাতে নেওয়া হলেও, বাস্তবে এটি হয়ে উঠেছে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। বিশ্বব্যাংক এবং আইডিএ ইতোমধ্যেই প্রকল্প থেকে বরাদ্দকৃত আড়াই হাজার কোটি টাকার দুই-তৃতীয়াংশ ফেরত নিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রকল্পের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে এটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের অর্থ লোপাটের হাতিয়ার।
পলক সিন্ডিকেটের ছায়া
সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রকল্প পরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেনসহ (পলকের সাবেক পলিসি হেড) একটি সিন্ডিকেট ইডিজিই প্রকল্পের মাধ্যমে পরিকল্পিত দুর্নীতি করেছেন। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের তিন বছর পার হলেও অগ্রগতি মাত্র ১৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক খাতের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করতেই প্রকল্পটি সাজানো হয়েছিল। প্রকল্পে ৩৬ জন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯৩ কোটি টাকা এবং প্রশিক্ষণ ও অনুদান খাতে ৬০৩ কোটি টাকা। এসব অর্থ ব্যয় করা হলেও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কোনো কাজের বাস্তব অগ্রগতি নেই।
অগ্রগতি: ফাঁকা প্রতিশ্রুতির বৃত্তে
ইডিজিই প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রযুক্তি উন্নয়ন চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর অনেক কিছুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। প্রাইভেট সেক্টর উন্নয়নের জন্য ন্যাশনাল জব পোর্টাল, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও কাজ বৃদ্ধির প্রকল্প তৈরি করা হলেও, পিডি শাখাওয়াত অকার্যকর করে রেখেছেন , এমনকি সরকারি অফিসের জন্য ইউনিফায়েড কমিউনিকেশন সিস্টেম তৈরির কাজও থমকে আছে। বিশ্বব্যাংক এবং আইডিএ প্রকল্পের দেড় হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে ফেরত নিয়ে গেছে। দাতাদের দাবি, প্রকল্পের আর্থিক অনিয়ম এবং নিম্নমানের অগ্রগতি এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
কেনাকাটায় দুর্নীতি
প্রকল্পের অধীনে গত বছর ৩১ জুলাই ক্লাউড সেবা সম্প্রসারণের নামে ১০৩ কোটি টাকার কেনাকাটা অনুমোদন করা হয়। দুটি লটে বিভক্ত এই বরাদ্দের কাজ দেওয়া হয় ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। প্রথম লটের ৫১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার কাজ পায় থাকরাল ইনফরমেশন সিস্টেমস, আর দ্বিতীয় লটের ৫১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার কাজ যৌথভাবে পায় ইএসএল ও ইউসিসিএল জেভি। দরপত্রে কারসাজি করে প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্ত
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ইডিজিই প্রকল্পের দুর্নীতির অনুসন্ধানে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে দেখা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তি ল্যাব নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। কমিটি প্রকল্পের একাধিক অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাতিল করার সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই কেবল অর্থ অপচয়ের জন্য পরিকল্পিত ছিল। নিজের লোক দিয়ে একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট ঢেলে সাজনঃ একাউন্টস হেড ফয়েজ আহমেদের নেতৃত্বে নিজের ভাতিজা এবং আত্মীয়দের নিয়োগ প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেন তার সব অনিয়মের সহযোগিতার জন্য।
সাখাওয়াতের সম্পদ ও দুর্নীতি
অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্ত ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন নিজে দুর্নীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। জানা যায়, তার ব্যক্তিগত সম্পদ, বিশেষ করে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট এবং কানাডায় তার পরিবারের জন্য বিপুল সম্পদ, সরকারি বরাদ্দের অপব্যবহারের স্পষ্ট উদাহরণ। এমনকি, তিনি নিজে যুগ্ম সচিব হিসেবে একটি গাড়ি পেলেও তা গোপন করে প্রকল্প থেকে আরও দুটি গাড়ির বাজেট দিয়ে ১টি বিলাসবহুল গাড়ি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবহার করেছেন। তার তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি কার্যত একটি ব্যক্তিগত তহবিল সংগ্রহের মেশিনে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইডিজিই প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ এভাবে ব্যর্থ হলে দেশের প্রযুক্তি খাতের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই প্রকল্পটি শুধু একটি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ ছিল না; এটি দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তিগত দক্ষতায় উন্নত করার এক অনন্য সুযোগ ছিল।