সরকারের জলবায়ু তহবিলের ৮৮৪ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছেন ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফার্মার্স ব্যাংক) বিভিন্ন শাখায় মেয়াদি আমানত হিসেবে জমা রেখে বেনামে ঋণ নিয়ে এ অর্থ আত্মসাৎ করেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এ ব্যবসায়ী।
পলাতক সরাফাতের পকেট থেকে এ অর্থ বের করে আনতে উপদেষ্টা পরিষদের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়। পদ্মা ব্যাংকে আমানত গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করা ও অন্যান্য আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও। জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
জলবায়ু তহবিলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত জলবায়ু তহবিল থেকে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) লিমিটেডের বিভিন্ন শাখায় ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক বছর মেয়াদে স্থায়ী আমানত হিসেবে ৫৯৭ কোটি ৬২ লাখ ৫২ হাজার ২৫২ টাকা গ্রহণ করে। চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারিত সুদ হারে ৮৭৩ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ টাকা স্থিতি হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদে থাকা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতও আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। ব্যাংকের বর্তমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে।
আমরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে দেখা করেছি, কথা বলেছি। ব্যাংক থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, ব্যাংকটির পদত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যাওয়া চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত বেনামে কয়েকটি শাখার মাধ্যমে এ অর্থ নিজের হিসেবে নগদায়ন করে আত্মসাৎ করেছেন। পদ্মা ব্যাংকের কাছে পাওনা জলবায়ু তহবিলের ৮৮৪ কোটির বিষয় কয়েকদিন আগে একটি সভা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, অর্থ উদ্ধারের সহযোগিতা চেয়ে উপদেষ্টা পরিষদে একটি সারসংক্ষেপ পেশ করার সিদ্ধান্ত হয় সভায়।
জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাজ বলেন, মন্ত্রণালয়ের পেশ করা সারসংক্ষেপ উপদেষ্টা পরিষদেও আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ জলবায়ু তহবিলের বেহাত হওয়া টাকা উদ্ধারে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সার্বিক সহযোগিতার নির্দেশনা দেয়। পদ্মা ব্যাংক থেকে জলবায়ু তহবিলের টাকা উদ্ধারের বিষয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছে একজন সাংবাদিক জানতে চান। জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয় ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) থেকে সুদ ও আসল মিলে ৮৮৩ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ টাকা পাবে।
বারবার টাকা চাওয়া সত্ত্বেও বর্তমান পদ্মা ব্যাংক সেই টাকা দিতে পারছে না। আমরা তাদের কাছে বারবার যোগাযোগ করেছি। ব্যাংকটির বর্তমান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে– তারা ২০৩৮ সালের আগে এ টাকা দিতে পারবে না। ফলে আমরা এটি উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করেছি।’
কেলেঙ্কারি ফার্মার্স থেকে পদ্মা ব্যাংকের মহা কেলেঙ্কারি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দলীয় নেতাদের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়। ২০১৩ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর নেন ফার্মার্স ব্যাংকের লাইসেন্স। যাত্রা শুরুর পর থেকেই নানা আর্থিক অনিয়মের কারণে দেশে আলোচনায় আসে এ ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেন ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যান ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও মো. মাহাবুবুল হক চিশতি ২০১৭ সালের নভেম্বরে ব্যাংকটি ছেড়ে দেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ফার্মার্স ব্যাংকের ব্যাপক অনিয়মের মধ্যেই আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এর দায়িত্ব দেন। ব্যাংকের নাম পাল্টিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ মহলের সহযোগিতায় সরকারের বিভিন্ন তহবিলের টাকা আমানত হিসেবে জমা রাখতে শুরু করেন। চারটি সরকারি ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ব্যাংকটির বড় অংশের শেয়ার অধিগ্রহণ করে। পাশাপাশি পদ্মা ব্যাংকে আমানতও রাখে। সরকারের মৌখিক নির্দেশে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটিতে প্রায় ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা জমা রাখে। আমানতকারীদের মধ্যে সবই সরকারি ব্যাংক, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি খাতের ট্রাস্ট তহবিল।
মহিউদ্দিন খান আলমগীরের পর চৌধুরী নাফিজ সরাফাতও সরকারের বিভিন্ন তহবিলের জমা রাখা অর্থ বেনামে ঋণ নিয়ে পালিয়ে যান। যার মধ্যে সরকারের জলবায়ু তহবিলের রয়েছে ৮৮৪ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন এরই মধ্যে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন কমিশনের এক কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিক যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি এর জবাব দেননি। জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী মোহাম্মদ তালহা জানান, এ বিষয়ে জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, কীভাবে অর্থ ফেরত দেওয়া যায়। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক হবে, সেখানেও বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও আলোচনা করবেন বলেও আমার দেশকে জানান তিনি।
বার্তাবাজার/এস এইচ