দেশের কয়েকটি জেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণের জন্য ব্যবসায়িকভাবে উপযুক্ত না হলেও কেবল অর্থ লোট ও নেতাদের খুশি করতেই দেয়া হয়েছে একের পর এক প্রকল্প। ১২টি জেলায় হাইটেক পার্কের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে আয়-ব্যয়সহ নানা অনিয়মের তদন্ত করছে কমিটি। এতে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অপচয়ের মচ্ছব পেয়েছে তদন্ত কমিটি। বিনিয়োগকারীদের টানতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, দূরত্ব ও গুরুত্বসহ অনেক বিষয়ে পরিকল্পনা না করে অর্থাৎ ব্যবসায়িকভাবে উপযুক্ত না হলেও কিছু জেলায় দেয়া হয়েছে হাইটেক পার্ক। এতে বেশিরভাগ হাইটেক পার্কে তেমন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নেই।

জানা যায়, দেশের ১২টি জেলার জন্য বিগত সরকার বরাদ্দ করে প্রায় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। তবে যে জেলাগুলোয় হাইটেক পার্ক নির্মাণের প্রয়োজন মনে করছে না এমন ৫টি হাইটেক পার্ক চিহ্নিত করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এগুলো হলোÑকুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার (রামু), সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া নাটোরের ৭ তলা ভবনের পরিবর্তে ৪ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের প্রায় ১ হাজার ৩১০ কোটি টাকা সাশ্রয় করছে।

জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। নানাভাবে প্রকল্পগুলোয় অনিয়ম করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য সুইটেবল নয় এমন জেলাগুলোয় হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এতে হাইটেক পার্ক নির্মাণ হলেও ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রয়োজন নেই এমন অনেক প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আবার ২ টাকা জিনিসের জন্য কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ৫ টাকা কাজে ২০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আমরা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো ইতোমধ্যে কিছু বাদ করেছি। যেখানে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল সেগুলো বাদ দিয়েছি। আরও অনেক প্রকল্প নিয়ে তদন্ত চলছে, পর্যায়ক্রমে আমরা সেগুলো নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করব মানুষকে জানানোর জন্য। একই সঙ্গে কীভাবে দেশ ও জনগণের অর্থ সাশ্রয় করে সর্বোচ্চ লাভ হয় তা দেখছি।’

আইসিটি মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ডিজিটালের নামে প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের বুলি উড়িয়ে গত সাড়ে ১৫ বছর দেশের আইসিটি খাতে লোটপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তবুও ডিজিটাল সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্নীতি কমানো, মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন, আইসিটি সেবা রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আইসিটি বিভাগের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভাগটি ৫৩টি প্রকল্প ও ৩৪টি কর্মসূচি নিয়েছে। যার মধ্যে ২২টি প্রকল্প এখনও চলমান। বাকিগুলো বাস্তবায়ন শেষ। সব মিলিয়ে ব্যয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটালাইজেশন-সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নেয়া প্রকল্পের ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পলিসি অ্যাডভাইজর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইসিটি নীতি উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে। সংস্কার যে মোটিভেশন সেই মোটিভেশনটাকে সামনে রেখেই আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। তদন্তে বিভিন্ন সুপারিশ এসেছে সেগুলোকেও আমরা আমলে নিচ্ছি। আমাদের উপদেষ্টার নির্দেশ যে প্রকল্পগুলোয় অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়েছে সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া এবং একই সঙ্গে সামনে যে প্রকল্পগুলো হবে তা হতে হবে সাশ্রয়ী, দুর্নীতিমুক্ত এবং ট্রান্সপারেন্ট ও ভবিষ্যৎমুখী। যাতে করে এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে উপকৃত হয়।’
সূত্র জানায়, প্রকল্পগুলোয় অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত যেসব অপচয়, অসংগতি, দুর্বলতা, আর্থিক ক্ষতি, অসম চুক্তি, সুবিধাভোগী নির্বাচনে অস্বচ্ছতা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, অনৈতিকতা, একই কাজ বারবার করার মতো বিভিন্ন বিষয় চিহ্নিত করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। কমিটি এ বিষয়ে পাঁচ দফা সুপারিশও করেছে।

আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তা ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আইসিটি খাতে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোর তেমন কোনো সুফল নেই। সম্ভাবনার নামে ‘গালগল্প’ শুনিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর দেখা গেছে, সেই অবকাঠামো তেমন কোনো কাজে লাগছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। প্রশিক্ষণের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তাতেও সুফল কম।
আইসিটি বিভাগের প্রকল্পগুলোয় অতিরিক্ত ব্যয় ধরা, ঘনিষ্ঠ লোকদের কাজ দেয়া, চাকরিতে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ থাকলেও তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জোনায়েদ আহমেদ পলকের ভয়ে কেউ কথা বলেনি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও তার কাছের লোকদের যখনই কোনো কিছু মাথায় আসত, তারা সেটাকে প্রকল্প বানিয়ে ফেলতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম দিয়ে নেয়া হয়েছিল ১১টি প্রকল্প। প্রশ্নহীনভাবে প্রকল্প অনুমোদন করাতে এই কৌশল নেয়া হতো। আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ খাতে সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা। বেশিরভাগ সময় বিদেশে থেকে তিনি এ দায়িত্ব পালন করতেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের রূপকল্প ঘোষণা করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া শুরু হয়।
আইসিটি বিভাগে উল্লেখযোগ্য সময় মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আবুল হোসেন (৫ ডিসেম্বর, ২০১১-২৩ জুলাই, ২০১২), মোস্তফা ফারুক মোহাম্মেদ (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২-১২ জানুয়ারি, ২০১৪) এবং আবদুল লতিফ সিদ্দিকী (১২ জানুয়ারি, ২০১৪-১২ অক্টোবর, ২০১৪)।
২০১৪ সাল থেকে টানা ১০ বছরের বেশি সময় আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জুনাইদ আহমেদ। তার বিরুদ্ধেই যথেচ্ছ প্রকল্প নেয়া এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বেশি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।

আওয়ামী লীগ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের রূপকল্প ঘোষণা করে। যদিও তখন প্রশ্ন উঠেছিল, ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণ না করে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করার সেøাগান দেয়া কেন।
হাইটেক পার্কগুলোয় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ইনকিউবেশন সেন্টারগুলো তেমন কাজে লাগছে না। যেমন যশোরে ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এটির উদ্বোধন করা হয়। তার আগে জুনাইদ আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছিলেন, যশোর হাইটেক পার্ক হবে বাংলাদেশের ‘সিলিকন ভ্যালি’। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি বহু প্রযুক্তি কোম্পানির আঁতুড়ঘর। গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সেটি অদ্বিতীয়।