হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্টের পূর্বাপর সারা দেশে থানাসহ পুলিশের ৪৬০টি অবকাঠানো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে শতকোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়। পুলিশের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড এখনো পুরো স্বাভাবিক হয়নি। এই সুযোগে বাড়ছে ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য দেয়। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, গত আগস্টে হামলায় থানায় ব্যাপক লুটপাট হয়। মামলার নথিসহ কোটি কোটি টাকার মালপত্রের হদিস এখনো মেলেনি। সহিংস হামলায় ১২০ থানায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। যার মধ্যে ৫৮টি থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৬২টি ভাঙচুর করা হয়। ১১৪টি ফাঁড়ির ক্ষতি হয়। এক হাজার ৭৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুলিশের সদর দপ্তর।গতকাল কথা হয় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, ওই সময় ১৫ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে পুরো থানাই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯টি অস্ত্র লুট করা হয়।
পুড়ে যায় সব নথিপত্র। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় চার কোটি টাকা। এখনো থানাটির সংস্কার করা হয়নি। ভাড়া থানায় কাজ হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র আরো বলেছে, ৫ আগস্ট পূর্বাপর ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন। এ ছাড়া হামলায় পুলিশের অনেক সদস্য আহত হন। যাদের মধ্যে ৫০৭ জন রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট সহিংসতায় থানার অবকাঠামোগত যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত ঠিক করতে হবে। সেই সঙ্গে পুলিশের মনোবল বাড়াতে নানান উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘বিগত সরকারের পতন ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। এ ধরনের ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন এর আগে পুলিশ বাহিনী কখনো পড়েনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের মনোবল ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘সারা দেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে বেশির ভাগ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে পুলিশ স্বাভাবিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে।’ ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতায় ৫০টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ৫ ও ৬ আগস্ট ২১টি থানায় ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে যায় ১৩টি থানা। থানাগুলো হলো—মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পল্টন, শেরেবাংলানগর, শ্যামপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ভাটারা, ওয়ারী ও খিলক্ষেত। সর্বশেষ গতকাল পর্যন্তও এসব থানার নিয়মিত কার্যক্রম (নাগরিক সেবা) পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তবে এই বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আবারও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফেরার চেষ্টা করছে পুলিশ।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ ও ৬ আগস্ট ডিএমপির ২১টি থানায় হামলা এবং ১৩টি থানায় অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুট করা হয়েছে অস্ত্র। এসব থানার মামলার নথিপত্র, পোশাক, গাড়ি ধ্বংসের পাশাপাশি হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন মাস পার হতে চললেও এখনো এসব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক করা যায়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যাত্রাবাড়ী, ভাটারা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাড্ডা, শ্যামপুর, খিলগাঁও, আদাবর, পল্টন, শেরেবাংলানগর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ওয়ারী ও খিলক্ষেত থানার। অন্য থানাগুলোরও যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা-ও এখনো পূরণ করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো এসব থানায় স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরেনি।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, থানা হচ্ছে পুলিশি সেবার মূল কেন্দ্র। থানা থেকে জনগণকে যথাযথ সেবা দিয়ে কাজের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। থানায় আসা সেবাপ্রার্থীরা যেন তাদের প্রত্যাশিত সেবা পায়। অতীতের কিছু উচ্চাভিলাষী পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।
ডিএমপির যেসব থানায় বেশি ক্ষতি
আগস্টের হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায়। সহিংসতার ঘটনায় আগুন দিয়ে থানা ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয় জানিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক তদন্ত মো. মোহসীন হোসাইন বলেন, আগস্টে থানায় আগুন দেওয়া হয়। অনেক পুলিশ সদস্য সেই আগুনে মারা যান। গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সব মিলিয়ে ৪০ কোটি টাকার মালপত্র পুড়ে ছাই হয়। এ ছাড়া মিরপুর, বাড্ডা, আদাবর, ওয়ারী, শ্যামপুর ও শেরেবাংলানগর থানার মামলার আলামত পুড়ে গেছে। হামলায় ক্ষতি হওয়া ভাটারা থানা সংস্কার করে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। জানতে চাইলে এই থানার ওসি মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, আতঙ্ক কাটিয়ে তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছেন।
ভাটারা, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, খিলক্ষেত ও খিলগাঁও থানার ওসিরা জানান, এই থানাগুলোতে লুট হওয়া, পুড়ে যাওয়া কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত মামলার নথিপত্রের হিসাব করা হয়েছে। তাদের কোটি কোটি টাকার মালপত্র পুড়ে গেছে। তারা এখন স্বাভাবিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত জুলাই মাসে সংঘাত-সহিংসতায় সারা দেশে দেড় শতাধিক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে (রাজধানীসহ ঢাকা জেলা) ১০৫টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, যার বেশির ভাগই ঘটেছে পুলিশ বাহিনীর স্থাপনা ঘিরে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, এসব অগ্নিসংযোগের ঘটনার মধ্যে ১৬ জুলাই দুটি, ১৭ জুলাই ১০টি, ১৮ জুলাই ২৫টি, ১৯ জুলাই ৪১টি এবং ২০ জুলাই ২৩টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর ২১ জুলাই ৯টি এবং ২২ জুলাই তিনটি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র শাহজাহান শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সহিংসতায় বেশির ভাগ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ বাহিনীর স্থাপনাকে কেন্দ্র করে।’
সরেজমিন চিত্র
রাজধানীর আদাবর থানায় গিয়ে দেখা গেছে, ওই থানার চারটি গাড়ি, ২০টি মোটরসাইকেল, ৩০টি ল্যাপটপ ও কম্পিউটার, পাঁচটি এসি, টিভি, কক্ষের দরজা, ফ্যান, ফ্লোরের কার্পেটসহ অন্যান্য আসবাবে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগের ফলে ভবনের অবকাঠামো ঝলসে গেছে। ওই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখনো বর্তমান থানার ভেতরে-বাইরে। গতকাল রবিবার দুপুরে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা যায়। দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য জানান, এখন আগের মতো মামলা ও অভিযোগ হচ্ছে না। সংখ্যা কমে গেছে। তবে এই থানায় দায়িত্বরত ১১৬ জন পুলিশ সদস্য চেষ্টা করছেন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে। আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে আদাবর থানার ওসি মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগস্টের সহিংসতায় এই থানার সব কিছু লুট হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের মেসের হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে সব কিছু লুট করা হয়েছে। আর যেগুলো নিতে পারেনি, সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গাড়ি, অস্ত্রসহ সংশ্লিষ্ট জিনিসগুলো পূরণ করতে একটু সময় তো লাগবেই।’
মিরপুর মডেল থানার পুলিশ জানিয়েছে, থানায় ৬৬০টি মামলার নথিপত্র এবং মালখানায় থাকা বিভিন্ন মামলার ২৩০টি আলামত পুড়ে গেছে। থানা ভবনে থাকা নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতাও পুড়ে গেছে। বিভিন্ন মামলার কেস ডকেট বা সিডি (সব নথিপত্র) পুড়ে গেছে। ওই থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন মামলার নথিপত্র নতুন করে তৈরি করতে সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে মামলার তদন্তে ব্যাঘাত ঘটবে। আর বিভিন্ন মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে লিখিতভাবে জানাবেন। প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হবে আদালতে।
বার্তাবাজার/এসএইচ