ভাঙনের মুখে মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি

কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সামনে রেখে আবারও অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়েছে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। চলমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে পার্টির শীর্ষ নেতারা মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। মতানৈক্যের কারণে ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পলিটব্যুরোর সদস্য বিমল বিশ্বাস দল ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রাথমিক সদস্যপদসহ পার্টির সব জায়গা থেকে তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। এদিকে এর পাঁচ দিনের মাথায় বৈঠক করে নির্বাহী কমিটি তাকে দল ভাঙার অভিযোগে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বহিষ্কার করেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে থাকা না-থাকা, গঠনতন্ত্রের নিয়ম উপেক্ষা করে কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টিতে নতুন সদস্য করা, সম্প্রতি ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির ঘটনায় রাশেদ খান মেননের নাম আসা, দলকে পাশ কাটিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদে নিজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খানকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য করাসহ নানা ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এ মতপার্থক্য চলে আসছে।

কেন্দ্রীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে এ মতপার্থক্য প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। এছাড়া পার্টির নেতাকর্মীদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ- কমিউনিস্ট আদর্শভিত্তিক পার্টির যে রাজনৈতিক চরিত্র থাকা উচিত রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি তা থেকে অনেক আগেই দূরে সরে গেছেন।

আগামী ২ নভেম্বর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির চার দিনব্যাপী দশম কংগ্রেস (কেন্দ্রীয় সম্মেলন) শুরু হবে। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে বেলা ১১টায় কংগ্রেসের উদ্বোধন হবে। কংগ্রেসে পার্টির রাজনৈতিক দলিল নিয়ে দ্বিমত করে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন দলটির পলিটব্যুরোর দুই সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদ। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ইকবাল কবির জাহিদ রোববার বলেন, ‘আমি ও নুরুল হাসান বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। পার্টিতে মতাদর্শগত কিছু পার্থক্যের কারণে আমরা দলিলে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি।’ এর বাইরে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ওয়ার্কার্স পার্টি আজ অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম কংগ্রেসে বাম ও দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির সুনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশগুলো চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে মতাদর্শিক সংগ্রাম করার কথা বলা হয়েছিল। সে কাজটি একেবারেই অবহেলিত ও গুরুত্বহীন থেকেছে। ফলে মতাদর্শিক শূন্যতার স্থান বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া মতাদর্শ পূরণ করেছে, আধিপত্য বিস্তার করেছে।

এতে বলা হয়, ওয়ার্কার্স পার্টিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হয়েছে। পার্টির রণনীতির স্থলে বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি স্থান পেয়েছে। সুবিধাবাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণির সরকারের অংশ হিসেবে পার্টি নেতৃত্বকে রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধাভোগী করে তোলার কাজ সুনিপুণভাবে করা হচ্ছে। ফলে পার্টির উচ্চস্তরে গড়ে উঠেছে একটি সুবিধাভোগী চক্র।

এতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব অর্জনের বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণা ও কর্মকৌশল সর্বক্ষেত্রে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি এবং এখন ওয়ার্কার্স পার্টি ১৪ দলের হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে ও সরকারে অংশ নিয়ে বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তির নজির স্থাপন করেছে। এর ফল হিসেবে বিপ্লবী রাজনীতি তো নয়ই পার্টি, বরং বিলোপবাদী ও জনস্বার্থপরিপন্থী হয়ে গণআকাক্সক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়- আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের নীতিনির্ধারণে শরিকদের ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ নেই। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন ও সরকারে অংশগ্রহণের ফলে সর্বক্ষেত্রে ওয়ার্কার্স পার্টিকে আওয়ামী লীগের শোষণ, লুণ্ঠন, গণবিরোধী কর্মকাণ্ড নীরবে হজম করতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু গরম গরম কথা বলে জনগণ এবং পার্টি কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টিতে নতুন সদস্য করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা। তাদের অভিযোগ- পার্টিতে সদস্য বাড়ানোর জন্য গঠনতন্ত্রের নিয়ম উপেক্ষা করে সদস্য করা হচ্ছে। পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে কংগ্রেসে জোরালো মত তৈরি করার জন্য এটা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।

রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সেখানে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি সামনে আসে। এ ক্লাবের চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ক্লাবটি উদ্বোধনও করেছিলেন তিনি। এরপর থেকে নানা মহলে সমালোচিত হচ্ছেন মেনন। এ নিয়ে পার্টির নেতাকর্মীদের কাছে প্রশ্নের মুখে আছেন তিনি।

দলকে পাশ কাটিয়ে স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খানকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য করা নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে আপত্তি রয়েছে। তাদের অভিযোগ, লুৎফুন্নেছা খান ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। পার্টিতে আলোচনা না করে তাকে সংসদ সদস্য করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, আসন্ন কংগ্রেসকে সামনে রেখে মূলত এসব বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে।

দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পার্টির অভ্যন্তরীণ এ বিষয়গুলোর নেতিবাচক প্রভাব জেলা সম্মেলনেও পড়েছে। বগুড়ায় দুটি জেলা কমিটি এবং নড়াইলে আলাদা দুটি সম্মেলন হয়েছে। ঝালকাঠি, পিরোজপুর, মাদারীপুর, যশোরসহ আরও কয়েকটি জেলায় সমস্যা রয়েছে।

এরই মধ্যে পার্টির পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সদস্যসহ সাবেক ছাত্রনেতাদের অনেকে কংগ্রেসে যোগ দেবেন না বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছে। এমনকি ঐকমত্য না হলে বিক্ষুব্ধ অংশ বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গঠন করতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। আর এ সংকট আরও উস্কে দিয়েছে বিমল বিশ্বাসের সরে দাঁড়ানোর ঘটনা। ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা পোষণ করে পার্টি ছেড়েছেন তিনি।

২২ অক্টোবর পার্টির কাছে এ সংক্রান্ত একটি প্রত্যাহারপত্র পাঠিয়েছেন বিমল বিশ্বাস। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বর্তমান ওয়ার্কার্স পার্টির মূল নেতৃত্ব মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কথা বললেও কাজ করেন এ আদর্শের বিরুদ্ধে। কৌশলের নামে নীতিকে জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলগত যে ঐক্য তাকে কাজে লাগানো হয়েছে এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার জন্য।’

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিমল বিশ্বাস রোববার বলেন, পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে সরে যাওয়ার একটি চিঠি পাঠিয়েছি। পরে আমি মেনন (রাশেদ খান মেনন) ভাইকে বিষয়টি ফোনে জানিয়েছি। একটি মার্কসবাদ, লেনিনবাদভিত্তিক কমিউনিস্ট আদর্শ থেকে অধঃপতিত নেতৃত্বের অধীনে কেউ পার্টি করতে পারে বলে আমি মনে করি না। ওয়ার্কার্স পার্টি এই আদর্শের অধিকার হারিয়েছে। এ কারণে পার্টি ছেড়েছি।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, দলে উত্থাপিত ‘অভিযোগ ও ভিন্নমত’ স্বাভাবিক। রোববার তিনি বলেন, একটি দলে অসংখ্য অভিমত থাকে। এবার আমাদের পলিটব্যুরোর দু’জন সদস্য লিখিতভাবে তাদের মত তুলে ধরেছেন। এ প্রস্তাব আমরা পুরো পার্টিতে প্রচার করেছি। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে মেনন বলেন, আমাদের যে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সাংগঠনিক দলিল সবার কাছে গেছে, সেখানেও এ ভিন্নমত যুক্ত করা হয়েছে।

এর ওপর প্রতি জেলায় আলোচনা হয়েছে। এরই ভিত্তিতে তারা অভিমত দিচ্ছেন। কংগ্রেসের আগে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এ অভিমতগুলো আমরা উপস্থাপন করব। যারা অভিমত দিয়েছেন, তারা কংগ্রেসে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। এরপর ঐকমত্য হলে ভালো, না হলে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হয়, তা-ই হবে। তিনি বলেন, পার্টিতে মতবিরোধ বা মতভিন্নতা আছে, তবে দল ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে কেউ দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা কিছু করতে চাইলে তো আর কিছু করার নেই।

উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউনাইডেট কমিউনিস্ট লীগ ও সাম্যবাদী দল (আলী আব্বাস) মিলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হয়। ১৯৯৫ সালে পলিটব্যুরোর সদস্য টিপু বিশ্বাস বেরিয়ে নতুন দল গণফ্রন্ট করেন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন বেরিয়ে যান পলিটব্যুরোর আরেক সদস্য সাইফুল হক। বর্তমানে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী কংগ্রেসকে সামনে রেখে পার্টি তৃতীয় দফায় ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ওয়ার্কার্স পার্টির একাধিক নেতা।

বার্তাবাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর