আগুন আতঙ্কো কি পেয়ে বসল ?

আগুন আতংক যেন রাজধানীবাসীর পিছু ছাডছে না। রীতিমত আগুন-আতংক স্থায়ীভাবে তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। চকবাজারের পর বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়ংকর অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর ৪১ ঘণ্টার মধ্যে গুলশানে ডিএনসিসির কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

চকবাজারে ৭১জন এবং বনানীতে ২৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এই দুই অগ্নিকান্ডে বহুলোক অগ্নিদগ্ধ ও আহত হয় অনিশ্চিয়তার সঙ্গী হয়েছে। ডিএনসিসির কাঁচাবাজারের আগুনে কেউ হতাহত না হলেও দুই শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের জীবিকা হারিয়েছে। এই তিনটি বড় অগ্নিকান্ডের পাশাপাশি আরো কিছু ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাতে তেমন কোনো ক্ষতি হয় নি।

চকবাজার ও বনানীতে ব্যাপক প্রাণহানিকর অগ্নিকান্ডের পর বিভিন্ন মহল থেকে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট, গোটা রাজধানীবাসী মারাত্মক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীর সাড়ে ১১ হাজার ভবন অগ্নিঝুঁকিতে আছে।

৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। ৯৩ শতাংশ ভবনে অগ্নি নির্বাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সংস্থান নেই। শুধু ভবনই নয়, অধিকাংশ মার্কেট, শপিং মল, বিপনীবিতান ও কাঁচাবাজারে অগ্নি নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। ভবন ও দোকানপাট নির্মাণে বিদ্যামান আইন-বিধি লংঘন, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন র্র্কতৃপক্ষের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি ও দুষ্কর্ম এবং সামগ্রিকভাবে সকলের সচেতনতা ও সতর্কতার অভাব এই আতংকজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। যে কোনো মর্মান্তিক প্রাণহানিকর অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলে সরকার, তার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার তরফে নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে ওই সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দেখা যায় না। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ ফাইলবন্দী থাকে এবং তার বাস্তবায়নের কোনো গরজ লক্ষ্য করা যায় না।

নিমতলী ট্রাজেডির পর কেমিক্যাল গুদাম ও দোকান সরিয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছিল। সেটা বছরের পর বছরে করা হয় নি। চকবাজার ট্রাজেডির মূল কারণ তো সেটাই। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, ভবনের ব্যবহার যোগ্যতার সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হলেও ভবন নির্মাতারা যেমন তার তোয়াক্কা করেনি বা করেনা তেমনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোও বিধিবিধান মানতে বাধ্য করার পদক্ষেপ নেয় নি বা নেয় না। নিলে বনানী ট্রাজেডি ঘটতে পারতো না।

গুলশানে ডিএনসিসির কাঁচা বাজারে আগুনের ঘটনাটিকে অনেকেই রহস্যজনক মনে করছেন। আগুন সুনির্দিষ্ট কোনো কারণে লেগেছে, নাকি কেউ লাগিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে এই কাঁচাবাজারটি আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ভষ্মিভূত হয়ে যায়। ক্ষুদ্র দোকান মালিকরা নি:স্ব ও সর্বস্বহারা হয় পথে এসে দাঁড়ায়। এরপর তারা ধার-দেনা ও ঋণ নিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। দু’বছরে তারা অনেকটাই ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলে। এখন তারা পুনরায় নি:স্ব হয়ে গেছে। মাথায় রয়েছে ঋণের বোঝা। এমতাবস্থায়, তারা কি করবে, তা ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়েছে।

২০১৭ সালের আগুন নাশকতা কিনা সে প্রশ্ন উঠেছিল। এবার সেই একই প্রশ্ন উঠেছে। ডিএনসিসি কাঁচাবাজারটিকে আধুনিক শপিং মলে পরিণত করতে চায়। শোনা যায়, একটি বিশেষ মহল কাজটি পাওয়ার জন্য অনেক দিন ধরে তৎপর রয়েছে।

বলাই বাহুল্য, গুনশানের মতো এলাকায় ওই ধরনের কাঁচাবাজার বেমানান। বাজারটির যথাযথ উন্নয়ন হওয়া দরকার। সেটা অবশ্যই সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে, তাদের সঙ্গে কথা বলে করতে হবে। তাদের উঠিয়ে দিয়ে, জায়গা দখল করে সেটা হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, দোকান মালিকরা সেখানে বংশ পরস্পরায় ব্যবসা করছে। তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার উপেক্ষা করে কোনো কিছু করা মোটেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কোনো মহলের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার অভিসন্ধি যদি গ্রাহ্যতা পায় এবং সেটা সফল হয়, তবে অনুরূপ ঘটনা আরো ঘটতে পারে, যার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।

কাজেই, এই অগ্নিকান্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে। আশা করা যায়, সঠিক তদন্ত হলে আগুনের কারণ বা রহস্য উন্মোচিত হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা স্পষ্টতই বলতে চাই, দোকান মালিকদের অধিকার ও স্বার্থ যে কোনো মূল্যে সংরক্ষণ করতে হবে। যা কিছুই করা হোক, তাদের সম্মতিতেই করতে হবে। যে প্রশ্ন উঠেছে, তা যদি সত্য হয়, তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দোকানমালিকদের ব্যবসা চালু করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দিতে হবে।

কারণ ছাড়া কার্যের উৎপত্তি হয় না। প্রতিটি অগ্নিকান্ডের পেছনেই কোনো না কোনো কারণ আছে। সেটা উদঘাটনের জন্য সঠিক তদন্তের বিকল্প নেই। তদন্ত হলে কোনো না কোনো কারণ জানা যাবে এবং তার জন্য কে বা করা দায়ী তাও জানা যাবে। দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। তার বা তাদের বিরুদ্ধে যথারীতি ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যেন এক্ষেত্রে মাথা তুলে না দাঁড়ায়। বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তাতে রাজনৈতিক রং চড়ানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনীতিটাই প্রধান হয়ে গেলে প্রকৃত দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আড়ালে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। একারণে অনেক অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা এবং তার বা তাদের সহায়তাকারী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা অধরা থেকে যায় বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। এ অভিমত আমলে নেয়ার দাবি রাখে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দুর্ঘটনার রাজনীতিকরণ পরিহার করতে হবে। উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর