বাবা মিষ্টি লাগবে না, পানি নিয়ে আসিও

গ্রামের কোনো নলকূপে পানি ওঠে না। ফলে গ্রামের মানুষ ডোবার অপরিচ্ছন্ন পানি দিয়ে রান্নাবান্না করছে। কেউ কেউ পুকুরের নোংরা পানি পান করছেন। আবার ওই পুকুরে গরু-ছাগল গোসল করাচ্ছেন।

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ-কাহারোল-বিরল ও সদর উপজেলার চিত্র এটি। এসব উপজেলার কয়েকটি গ্রামে চলছে পানির জন্য হাহাকার। কোনো কোনো গ্রামের মানুষ দুই কিলোমিটার দূরে গিয়ে নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। আবার কিছু এলাকায় রাতে নলকূপে একটু করে পানি ওঠায় রাত জেগে পানি সংগ্রহ করছেন। অনাবৃষ্টি আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গ্রামে গ্রামে চলছে পানির জন্য হাহাকার।

জানা যায়, বোরো চাষের জন্য নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে এসব গ্রামের মানুষ। প্রতি বছর পানির স্তর গড়ে ১ দশমিক ২৩ ফুট করে নিচে নামছে। অনেক এলাকায় চাষাবাদ তো দূরের কথা, মানুষের খাবার পানি পাওয়া দুষ্কর।

বীরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর গোলঘরা এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে হাঁড়ি-পাতিল, বালতি ও কলস নিয়ে পানি সংগ্রগ করতে যাচ্ছেন গ্রামের নারীরা। তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা যায়, ৫৩নং লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নলকূপে পানি উঠছে। সেখানে লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন তারা।

এখানে পানি সংগ্রহ করতে আসা লক্ষ্মীপুর গ্রামের আরতি বালা (৫৫) বলেন, ‘বাউ সাতদিন ধরি গাও ধওনাই জল বেগরে (পানির অভাবে)। হামার যে কি জিল্লতি শুরু হইছে, একদিন থাকিলে বুঝা পাবেন।’

বীরগঞ্জ উপজেলার ৭নং মহাম্মদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোপাল দেব শর্মা বলেন, লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাত জায়গায় মাটি খুঁড়ে পাইপ বসিয়েও পানি পাওয়া যায়নি। পুকুরের মাটি খুঁড়েও পানি মেলেনি। এই ইউনিয়নের কোনো নলকূপে পানি উঠছে না। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ ৫৩নং লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছে। অনেকে দুুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করার জন্য আসছে। মানুষ আর গরু এক পুকুরে গোসল করছে। থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করছে। আবার সেই পুকুরের পানি পান করছে গ্রামের মানুষ।

লক্ষ্মীপুর গ্রামের নারী ইউপি সদস্য গান্ধাধারী রায় বলেন, ‘এলাকার মানুষ বলছে রাস্তাঘাট চাই না, পানি চাই। পানি না দিলে ভোট দেব না। এরপরও আমরা তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে পারছি না।’

পাশের গ্রামের কৃষক ভবেষ চন্দ্র রায়, অনিল রায় ও গোলাম মোস্তফা বলেন, জমি আবাদ তো দূরের কথা পানির অভাবে মুখ-হাত ধুতে পারি না। গোসল করি না কতদিন। খাবার পানি নেই, রান্নাবান্নার পানি নেই। আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাড়ি আসতে চাইলে বলি, বাবা মিষ্টি লাগবে না, পানি নিয়ে আসিও। আমাদের গ্রামে এক ফোটা পানিও নাই।

লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র আলম হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ও সুমন চন্দ্র রায় জানায়, গত এক মাসে তিন-চারদিন গোসল করেছি আমরা। আমাদের মায়েরা পানি সংগ্রহ করতে রাত জেগে নলকূপ চাপেন। অনেক সময় দুই কিলোমিটার দূরে পানি সংগ্রহ করতে যান তারা। আমরা অনেক কষ্টে আছি ভাই।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের বীরগঞ্জ উপজেলার প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বলেন, এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় বেশকিছু এলাকায় পানি উঠছে না। আমরা ইতোমধ্যে ১৩টি নলকূপ বসানোর পদক্ষেপ নিয়েছি। এসব নলকূপের জন্য হেড অফিসে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।

এদিকে পানির জন্য হাহাকার চলছে কাহারোল-বিরল ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। সদরের ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টিতে পানির ভয়াবহ সংকট। বিভিন্ন মেশিন বসিয়ে বড় বড় গর্ত খুঁড়েও পানির সন্ধান পাচ্ছে না গ্রামের মানুষ।

বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, বীরগঞ্জের কিছু এলাকায় আমরা খাবার পানি সরবরাহ করি। এরপরও পানির সংকট কিছু এলাকায়। এরই মধ্যে বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়ামিন হোসেন কয়েকটি গ্রামে খাবার পানি সরবরাহের জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। পাইপ সংগ্রহের কাজ চলছে। দ্রুত সময়ে বীরগঞ্জ উপজেলায় খাবার পানি সরবরাহ করা হবে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর